রবিউল হক
সবুজ সোনার দেশ তথা হিমালয় কন্যা খ্যাত পঞ্চগড় জেলার অবস্থান বাংলাদেশের সর্ব-উত্তরে। ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের এ জেলা ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক দিক থেকে ঐতিহ্যময় সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বহন করে। এ জেলায় রয়েছে দীর্ঘদিনের লালন করা নানা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এর মধ্যে লোকচিকিৎসা ও লোকমন্ত্র বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
অলৌকিক ও অদৃশ্য শক্তির ওপর অগাধ বিশ্বাস আদিকাল থেকেই মানুষের মনের বিশেষ স্থান দখল করে রেখেছে। তথ্য-প্রযুক্তির বর্তমান বিশ্বেও প্রাকৃতিক গাছগাছালির ওষুধের উপর সাধারণ মানুষের আস্থা ও অগাধ বিশ্বাস এখনো সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বহমান। আমাদের লোকসমাজে অলৌকিক শক্তির অধিকারীগণ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। যেসব রোগের প্রাকৃতিক চিকিৎসা দেয়া হয় তার মধ্যে কুকুর কামরানো, সাপে কাটা, জলে ডুবা, ভূতে ধরা, চোখের ছানি পড়া, বুকের কড়ি উঠা, শরীরের বিভিন্ন ধরনের বাতের ব্যাথা, গুড়া কৃমি, রক্ত আমাশয়, মেহ রোগ, আধ-কপালি বিষ বা ব্যাথা, আন্ধাশুলা বা রাতকানা, পেট ব্যাথা, দাঁত ব্যাথা, মাজা ব্যাথা প্রভৃতি ছাড়াও আরো নানান রোগের মুক্তি কামনায় কবিরাজি ও ঝাড়ফুকের মতো লোকচিকিৎসা আজো শুধু বিশ্বাসের ওপর ভর করে অটুট রয়েছে।
মন্ত্র বা যাদুবিদ্যার উদ্ভব ও বিকাশ প্রচীনকাল হতেই। প্রাচীন সমাজে ধর্মের চেয়েও বরং যাদু-মন্ত্র বা অলৌকিক শক্তির ওপর ছিল অগাধ বিশ্বাস। পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে আজো ডাক্তার কবিরাজের তুলনায় মন্ত্রজ্ঞ ব্যক্তির কদর অনেক বেশি। মধ্যযুগের ‘কোচ’ রমণীদের যাদুবিদ্যায় পারদর্শী বলে মনে করা হতো। বাংলার লোকসমাজে মন্ত্রে বিশ্বাস সুদীর্ঘকালের। মন্ত্র বা যাদুবিদ্যাকে আদিম মানব সমাজের বিজ্ঞান হিসেবে তুলনা করা হয়েছে। যাদুবিদ্যা হিসেবে মন্ত্র পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের জীবনে অলৌকিক সত্তা হিসেবে মিশে রয়েছে। অলৌকিক শক্তি বা মন্ত্রের প্রতি অগাধ বিশ্বাস গ্রামীণ মানুষের পাশাপাশি শিক্ষিত মহলেও লক্ষ করা যায়। তন্ত্র-মন্ত্র দ্বারা যেসকল রোগ নিরাময় করা হয় তার মধ্যে পেটের ব্যাথা নিরাময়ের মন্ত্র, গায়ে বা বগলে ফোড়া নিরাময়ের মন্ত্র, বাতের ব্যাথার মন্ত্র, অজ্ঞান হয়ে পড়ার মন্ত্র, ধানে পোকা তাড়ানোর মন্ত্র, মুরগি জবাই করার মন্ত্র, গোখরা সাপ ধরার মন্ত্র, ভাঙ্গা মচকা ভাল করার মন্ত্র, মেয়ে ভুলানো মন্ত্র, বাটি বা হাত চালানির মন্ত্র, জল বা গুটি বসন্ত রোগ নিরাময়ের মন্ত্র, গরুর নাভিতে পোকা তাড়ানোর মন্ত্র প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ জেলার শরীর বন্ধের মন্ত্র হলো-
“কিষ্টা কিষ্টি কুকুর ডাকে
কালীমাই মস্তকে চড়ে
ডাহিনে আল্লা বামে ধূত
এই দেহা মন করেছু
এই কালিকার পুত
চড়াবো যাও
দোহাই লাগে শিব চণ্ডী মাথাত
মুছিব দুই পাও্”।
এছাড়াও আরো নানা মন্ত্রের প্রচলন রয়েছে এবং এসবে সাধারণ মানুষের অগাধ বিশ্বাস লক্ষ করা যায়।
তথ্যসূত্র
১. শামসুজ্জামান খান, বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা: পঞ্চগড়, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৩
২. নাজমুল হক, উত্তরবঙ্গের লোকসাহিত্যের নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক সমীক্ষা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০৭
৩. মাযহারুল ইসলাম (সম্পা.), ফোকলোর (চতুর্থ বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা), ঢাকা, ২০০১
৪. তপন বাগচী, লোকসংস্কৃতির কতিপয় পাঠ, গতিধারা, ঢাকা, ২০০৮
আই.কে.জে/