বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ। ফাইল ছবি
কোনো জাতির জীবনে শত শত বীরত্বগাথা থাকে। সেখানে সব সময় তুলনামূলক গুণাগুণ বিশ্লেষণে যাওয়া এবং তুলনা করে কারও প্রশংসা বা সমালোচনা অপ্রয়োজনীয় ও ভুল। এ রকম কর্মকাণ্ড গত আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ইতিহাসের পাতায় আরো বড় করে দেখাতে গিয়ে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদকে অমর্যাদার ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ আছে। সাবেক আওয়ামী লীগের সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও তা করা হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও উপসচিব পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী শাহ আলী ফরহাদও তা করছিলেন।
শাহ আলী ফরহাদের ওই মন্তব্যের তখন প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমদ সোহেল তাজ। এ ঘটনা ২০২০ সালের জুলাইয়ের। প্রয়াত সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান ওই বছরের ২৮শে জুলাই বিষয়টি নিয়ে কলাম লিখেছিলেন দৈনিক প্রথম আলোতে, যা 'তাজউদ্দীন আহমদ পরিবারের ক্ষোভ যথার্থ' শিরোনামে ছাপা হয়। তিনি কলামে বলেছিলেন, 'তাজউদ্দীন আহমদের পরিবারকে প্রকাশ্যে কটাক্ষ করার বিষয়টি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক শিষ্টাচার সমর্থন করতে পারে না। এখানে শুধু কটাক্ষ নয়, ওই কর্মকর্তা (শাহ আলী ফরহাদ) রীতিমতো তাজউদ্দীন আহমদ পরিবারকে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছেন।'
মিজানুর রহমান খান লেখেন, 'শাহ আলী ফরহাদের মন্তব্য অসদাচরণের পর্যায়ে পড়ে কী না, সেটা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় খতিয়ে দেখতে পারে। ওই মন্তব্যের লক্ষ্য বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের ক্ষুব্ধ বা বিভ্রান্ত করা।' প্রসঙ্গত, গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী শাহ আলী ফরহাদের বাবা একাত্তরের রাজাকার ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে বধ্যভূমির ভূমি দখলে তার বাবার বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ আছে। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হয়ে প্রভাব খাটিয়ে নিজের যুদ্ধাপরাধী বাবাকে 'মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত' করার অভিযোগও আছে শাহ আলীর বিরুদ্ধে।
গতকাল ২৩শে জুলাই, বুধবার ছিল তাজউদ্দীন আহমদের জন্মদিন। তিনি ১৯২৫ সালের এ দিনে গাজীপুরের কাপাসিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার এবারের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকায় গতকাল একাধিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। কোনো কোনো আয়োজনে কারো কারো আলোচনায় তাজউদ্দীনকে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের 'প্রতিপক্ষ' হিসেবে দেখানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। গত বছরের ১৫ই আগস্টকে (শেখ মুজিবকে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ হত্যাকাণ্ডের দিন) যেসব গণমাধ্যম এড়িয়ে গেছে, তেমন একাধিক গণমাধ্যমকে এবার বঙ্গতাজের জন্মদিন উপলক্ষে বেশ সোচ্চার দেখা যায়। কারো কারো আয়োজন 'একধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত' বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযোগ করেন অনেক নেটিজেন।
তাজউদ্দীনের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল ঢাকার আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে আয়োজিত এক স্মরণানুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক মাহফুজ আনাম। তাজউদ্দীনের এবারের জন্মদিন উপলক্ষে আলোচনা অনুষ্ঠানে যারা বক্তব্য দিয়েছেন, সামাজিক মাধ্যমে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত হচ্ছেন মাহফুজ আনাম। নেটিজেনরা শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন সম্পর্কে তার মূল্যায়নকে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ বলে মনে করছেন। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব যুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জন্মশতবর্ষ স্মরণানুষ্ঠান’ শিরোনামে গতকালের অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
সেখানে মাহফুজ আনাম বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদের ঐতিহাসিক ভূমিকা পরবর্তী সময়ে উপেক্ষার শিকার ছিল। এ জায়গায় আমরা ব্যক্তিগতভাবে, প্রতিষ্ঠানগতভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্বে আক্রান্ত। আমি স্মরণ করতে চাই, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কী ধরনের চেতনা ও আলোচনা আমরা করেছি, সেটা নিয়ে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার যাত্রা শুরু করে। এরপর আমাদের একটা বিরাট বিতর্ক তৈরি হলো বাকশাল নিয়ে। সব কাগজ (পত্রিকা) বন্ধ করে দেওয়া হলো, সব দলকে নিষিদ্ধ করা হলো। এ পদক্ষেপ ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যাত্রায় প্রথম ধাক্কা।'
তিনি বলেন, ‘'এরপর আমরা দেখলাম, বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যা। বাংলাদেশে অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে আমরা কোনোদিনই ভাবিনি আবার সেনাবাহিনী আসবে, তারা দেশ পরিচালনা করবে। আমরা ১৯৭৫ থেকে ’৯১ সাল পর্যন্ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেনাশাসনের মধ্যে থাকলাম। সেনাশাসকদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের বয়ান নিয়ন্ত্রণ করার একধরনের চেষ্টা ছিল। আমরা সুষ্ঠু ও বস্তুনিষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পেলাম না। এরপর আমরা গেলাম গণতন্ত্র (১৯৯১)। সেখানে বিএনপির মুক্তিযুদ্ধের বয়ানকে সম্পূর্ণভাবে অন্যদিকে প্রবাহিত করার একটা উদ্যোগ দেখলাম। এরপর শেখ হাসিনার সরকারে সেটার বিপরীত যাত্রা দেখলাম।"
মাহফুজ আনাম মনে করেন, 'পরবর্তীকালে খালেদা জিয়ার সরকার ও সর্বশেষ হাসিনার সময়ে বস্তুনিষ্ঠ বয়ান তৈরি হয়নি। আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর উদ্যাপন করলাম, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা একটা ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার দিকে চলে গেল। জনসাধারণ ও লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা—তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও তাদের প্রতি জাতির কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের ঘটনা ৫০ বছরের উদ্যাপনের মধ্যে দেখিনি। এ পুরো ধারাবাহিকতার মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদের যে ভূমিকা, সেটা বারবার বলতে পারেন যে, উপেক্ষিত হলো। কোনোদিন আমরা ওইভাবে তার অবদান (স্বীকারের বিষয়টি) পাইনি। তাজউদ্দীন আহমদ যে একজন মহান ব্যক্তিত্ব, তার নিষ্ঠা, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, সততা ও নৈতিকতা—সবকিছু নিয়ে তিনি সত্যিকার অর্থে অনন্য ব্যক্তিত্ব।’
তিনি বলেন, ‘আজকে (২৩শে জুলাই) যে জন্মশতবর্ষ খুব সীমিতভাবে উদ্যাপন হচ্ছে, আরও যে ব্যাপক আকারে উদ্যাপন হচ্ছে না; বুদ্ধিজীবী, নাগরিক সমাজ, চিন্তক সংগঠন, তারাও যে তার জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন করছে না, এটাই প্রমাণ করে যে, আমাদের ইতিহাসের প্রতি একটা অনীহা। এ জায়গায় আমরা ব্যক্তিগতভাবে, প্রতিষ্ঠানগতভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্বে আক্রান্ত। তাজউদ্দীন ও বঙ্গবন্ধুর যে একটা নৈকট্য ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, পুরো বিষয়টি মুদ্রার এপিঠ ও ওপিঠের মতোই। জনগণকে জাগিয়ে তোলার মতো বঙ্গবন্ধুর যে বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষমতা, সেটা তাজউদ্দীনের ছিল না। তবে তাজউদ্দীনের দলকে সুসংগঠিত করার, গোছানোর অনন্য ক্ষমতা ছিল।'
এ দু'জনের মধ্যে কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নেতা বঙ্গবন্ধু ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী তাজউদ্দীন। তাদের মধ্যে এমন কোনো রকম রাইভালরি (দ্বন্দ্ব) ছিল না যে দলের নম্বর টু (দ্বিতীয় প্রধান) হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ অস্বস্তি বোধ করেছেন। এটা ছিল ব্যক্তিগত আস্থা ও রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দারুণ সহযোগিতামূলক সম্পর্ক।’ এ সম্পর্ককে চীনের বিপ্লবের নেতা মাও সে-তুং ও চৌ এনলাইয়ের সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করে ডেইলি স্টার সম্পাদক বলেন, তাজউদ্দীন আহমদের রেখে যাওয়া উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার মধ্যে গণমুখী রাজনীতি কীভাবে করতে হয়, সেটার নিদর্শন আছে।
খবরটি শেয়ার করুন