ছবি: সংগৃহীত
লেখক, গবেষক ও দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে শারমিন আহমদ আওয়ামী লীগের হাল ধরতে পারেন, দলটির শীর্ষ পর্যায় থেকে তাকে এ অনুরোধ জানানো হয়েছে, বিষয়টি ফের আলোচনায়। গত বছরের ৫ই আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের সরকারের ক্ষমতাচ্যুত হওয়া ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে চলে যাওয়ার পর থেকে তাজউদ্দীন পরিবারের কেউ আওয়ামী লীগের চরম দুর্দিনে দলটির নেতৃত্বে (‘রিফাইন্ড’ বা ‘পরিশুদ্ধ’ আওয়ামী লীগ) আসছেন, রাজনীতিতে এমন কথা চাউর হচ্ছে বারবার, যেভাবে অতীতে দলটির ক্রান্তিকালে ১৯৭৭ সালে এর হাল ধরেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী প্রয়াত জোহরা তাজউদ্দীন।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশ থেকে আওয়ামী লীগের নয়বারের সভাপতি এবং তখনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে চলে যাওয়ার পর গণহত্যায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দলটি ও এর নেতাদের বিচারকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। আওয়ামী লীগের এমন সংকটময় মুহূর্তে আবারো দলটির ‘পরিশুদ্ধ’ নেতৃত্বের আলোচনায় তাজউদ্দীন পরিবার।
৫ই আগস্টের কিছু সময় পরই তাজউদ্দীন পরিবারকে দলটির কর্মীরা ডাকছেন বলে দেশীয় গণমাধ্যমকে জানান তাজউদ্দীনের বড় মেয়ে শারমিন। তিনি ও তার ভাই এবং আওয়ামী লীগের সাবেক সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমদ সোহেল তাজ দলটির নেতৃত্ব নেওয়ার কথা সরাসরি স্বীকার না করলেও তারা গণমাধ্যমকে এক্ষেত্রে একধরনের কৌশলী জবাব দিয়ে আসছেন শুরু থেকেই।
একাধিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞের মতে, তাজউদ্দীনের এবারের জন্মবার্ষিকী (২৩শে জুলাই) উপলক্ষে রাজনীতিতে প্রভাবশালী কিছু গোষ্ঠীকে বেশি সোচ্চার দেখা যায়। তার জন্মদিন উদযাপনে ভিন্নভাবে তৎপর ছিল সেসব গোষ্ঠী। তাদের আলোচনা অনুষ্ঠানে তাজউদ্দীনকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের ‘প্রতিপক্ষ’ হিসেবে দেখানোর প্রবণতা যেমন লক্ষ্য করা গেছে, তেমনি তাজউদ্দীনের পরিবারের সদস্য, বিশেষ করে শারমিনকে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয়েছে।
এসবের মধ্য দিয়ে তাজউদ্দীন পরিবারকে আলোচনায় আনার নতুন বার্তা দেওয়া হয়েছে, ফলে এ পরিবার আবার আলোচনায়। তাজউদ্দীন পরিবারের রাজনৈতিক মর্যাদা ও শারমিনের আন্তর্জাতিক পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি থাকায় এখনকার পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব হিসেবে তিনি গ্রহণযোগ্য বিকল্প বলে রাজনীতিতে প্রভাবশালী কোনো কোনো গোষ্ঠী ভাবছে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব হিসেবে তিনি সেনাবাহিনীর কারো কারো কাছেও গ্রহণযোগ্য বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গত বছরের ১৫ই আগস্টকে (বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ হত্যাকাণ্ডের দিন) যেসব গণমাধ্যম এড়িয়ে গেছে, তেমন একাধিক গণমাধ্যমকে এবার বঙ্গতাজ তাজউদ্দীনের জন্মদিন উপলক্ষে বেশ উৎসাহী দেখা যায়। কারো কারো আয়োজন নিঃসন্দেহে ভিন্ন বার্তা দেয়। বিশেষ করে, দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের মতো প্রভাবশালী দুটি দৈনিকের কার্যক্রম দেখলে তা আরো স্পষ্ট হয়।
পত্রিকাগুলো তাজউদ্দীনের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শারমিনকে হাইলাইটস করে বিশেষ লেখা ছাপিয়েছে। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান নিজে শারমিনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার তিনটি পর্বে প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম আলোর মতো একটি পত্রিকায় তিন পর্বে সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হওয়ার মতো ব্যক্তিত্ব এখনো নন শারমিন।
কিন্তু পত্রিকাটি এটা করেছে শারমিনকে বড় করে তোলে ধরা ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের মুখপত্র নয়। তারা নিজেরাই সরকার ও রাজনীতিতে নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একটি শক্তির ভূমিকা পালন করে আসছে। তাজউদ্দীন ও শারমিনকে নিয়ে পত্রিকা দুটির হঠাৎ করে অতি উৎসাহ অকারণে নয়।
আওয়ামী লীগের পরিশুদ্ধ অংশকে সাবের হোসেন চৌধুরী, শিরীন শারমিন চৌধুরী, বা শেখ ফজলে নূর তাপসের নেতৃত্বে রাজনীতিতে ফেরানোর সম্ভাবনা নিয়ে মাঝে যে আলোচনা বা শোরগোল চলে, তা বর্তমান পরিস্থিতিতে বাস্তবসম্মত ছিল না। কারণ, সাবের, তাপস, শিরীন নিজেরাই নানাভাবে বিতর্কিত। এ তুলনায় শারমিন আহমদের ভাবমূর্তি পরিচ্ছন্ন এবং রাজনৈতিকভাবেও তিনি দেশের অন্যতম প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য।
একাত্তরে যুদ্ধাঞ্চলগুলোতে গিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। ফাইল ছবি
নিজের লক্ষ্যের বিষয়ে শারমিন আহমদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বলতে পারি, আমার রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা নেই। কিন্তু আল্লাহ কখন কাকে দিয়ে কী করাবে ইউ নেভার নো।’ সময়ের প্রয়োজনে শারমিন আহমদকে যদি আওয়ামী লীগের বিধ্বস্ত দিনে নেতৃত্ব নিতে হয়, দলটির বেশিরভাগ নেতাকর্মী কী তাকে মেনে নেবেন?
আত্মগোপনে থাকা ও বিভিন্ন মামলার আসামি এমন অনেকে বলেন, দলের দুর্দিনে গত প্রায় এক বছরে শারমিন কোনো নেতাকর্মীর পাশে দাঁড়াননি। এভাবে রাজনীতি হয় না। নেতৃত্ব হঠাৎ করে অর্পিত হয় না, ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। তাছাড়া আওয়ামী লীগের যে শীর্ষ নেতারা শারমিন আহমদকে নেতৃত্বে আসতে বলছেন, তারা কারা?
নেতাদের অভিযোগ, বিদেশে পলাতক ও নিরাপদ অবস্থানে থাকা অনেক নেতা বিদেশি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তারা সরব। তাদের মধ্যে কেউ এখনো পর্যন্ত শারমিনের পক্ষে কিছু বলেননি। আওয়ামী লীগের সমর্থক দেশের একটি পত্রিকার সম্পাদক একবার এক লেখায় উল্লেখ করেন, শারমিনের মিসরীয় বংশোদ্ভূত স্বামী মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা।
মুসলিম ব্রাদারহুড মৌলবাদী রাজনৈতিক সংগঠন এবং একে মিসরের সরকার সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছে। দলটির সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাংলাদেশে গণহত্যার দোসর রাজনৈতিক সংগঠনের আদর্শিক সখ্য রয়েছে। এসব কারণে শারমিন সম্পর্কে আওয়ামী লীগের একটি অংশের মধ্যে নেতিবাচক প্রচারণা আছে।
প্রসঙ্গত, দেশীয় একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক অভিযোগ করেছিলেন, ২০১১ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি মিশরে স্বৈরাচারের পতনের দিন দেশটির তাহরির স্কয়ারে শারমিন আহমদের হাতে মুসলিম ব্রাদারহুডের পতাকা ছিল। ওই সম্পাদকের লেখা তখন ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী বিষয়টি ছড়িয়ে দেন সামাজিক মাধ্যমে। দলটির অনেক নেতাকেই অতীতে শারমিন আহমদের কঠোর সমালোচনা করতে দেখা গেছে। এসব কারণে শারমিন আহমদ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এলেও সুবিধা করতে পারবেন কী না, দলটির মধ্যে ঐক্যের প্রতীক হতে পারবেন কী না, এ বিষয়ে অনেকে সন্দিহান।
‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা’ নামে একটি বই লেখার জন্য শারমিন আহমদকে অতীতে আওয়ামীপন্থী সাংবাদিকদের সামনে বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। একবার একাত্তর টিভির উপস্থাপক তাকে টকশোতে জিজ্ঞাসা করেন, ‘সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতা ওমর ফারুকের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী?’
তিনি জবাব দেন, ‘ওমর ফারুক!’ এরপর তাকে উপস্থাপক জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনাকে তো তাহরির স্কয়ারে জিহাদি পতাকা হাতে দেখা গেছে।’ শারমিন জানান, ‘ওটা তো মিসরের পতাকা। আমার স্বামী একজন মিসরীয়। আমার শ্বশুরবাড়ি মিসরে। জনকণ্ঠ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে তাহরির স্কয়ারের গণ–অভ্যুত্থান নিয়ে আমার লেখা ছাপা হয়েছে।’
যমুনায় সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তাজউদ্দীন কন্যা শারমিন আহমদ এবং পুত্র তানজিম আহমদ সোহেল তাজ। ছবি: পিআইডি
অবশ্য স্বামীর সঙ্গে মুসলিম ব্রাদারহুডের কথিত সম্পর্ক, তাহরির স্কয়ারে সংগঠনটির পতাকা বহন করার অভিযোগ প্রসঙ্গে শারমিন আহমদ দৈনিক প্রথম আলোর মাধ্যমে লিখিত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এই প্রচারণাটি নিছক অপপ্রচারণাই শুধু নয়, এটি চরিত্র হননকারী, অনৈতিক, মানহানিকর, যা বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়ার উপযুক্ত।’ তার প্রতিক্রিয়া পত্রিকাটিতে ‘সত্যনিষ্ঠা বনাম মিথ্যা এবং ইতিহাসের সাথি যারা’ শিরোনামে ২০১৫ সালের ২১শে জানুয়ারি প্রকাশিত হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীতে আওয়ামী লীগের দুর্দিনে জোহরা তাজউদ্দীন হাল ধরার সময় তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক ভালো ছিল। তিনি ছিলেন দলটির সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। শারমিনের বেলায় আওয়ামী লীগের অনেকের কাছে চিত্রটা ভিন্ন। বিশেষ করে, তার ‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা’ বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে যেমন পাঠকমহলে বহুল প্রশংসিত হয়েছে, তেমনি সমালোচিতও হয়েছে।
আওয়ামী লীগের অনেকে রাজনৈতিক স্বার্থে বইটিকে খণ্ডিতভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করেন বলে তিনি নিজেই অভিযোগ করেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব তার বইটিকে ভালোভাবে নেয়নি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তখন বইটি ও এর লেখক শারমিনের সঙ্গে বিভিন্নভাবে বৈরিতাপূর্ণ আচরণ করে। এমনকি তার বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানেও গোয়েন্দারা নানা বাধার সৃষ্টি করেন।
আওয়ামী লীগের (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত) এক সাংগঠনিক সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলে নতুন নেতৃত্ব প্রসঙ্গে দৈনিক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এ মুহূর্তে একমাত্র দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। প্রায় প্রতিদিন শেখ হাসিনা নিজে বিভিন্ন সাংগঠনিক ইউনিটের সঙ্গে সভা করছেন। আওয়ামী লীগ এর আগেও নানা ধরনের সংকটকাল পার করেছে। বর্তমানে যে সংকটে রয়েছে, সেটি উত্তরণের লক্ষ্যে নানা ধরনের কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। অনেক সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে।’
আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য সূত্র সুখবর ডটকমকে জানায়, নতুন নেতৃত্বের ধারণা নিয়ে দলটির ভেতরে কোনো আলোচনা নেই। নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার বিষয়েও কোনো চিন্তাভাবনার কথা জানা যায়নি। এ বিষয়ে দলটির প্রধান নেতৃত্বের কোনো সায় আছে—এমন আভাসও পাওয়া যায়নি। ফলে আওয়ামী লীগের পরিশুদ্ধ অংশকে রাজনীতিতে ফেরানোর সম্ভাবনা নিয়ে যে আলোচনা বা শোরগোল চলছে, তা বাস্তবসম্মত নয়।
অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে আওয়ামী লীগ ভুল স্বীকার করবে কী না, এমন একটা আলোচনা আগেও হয়। কিন্তু উল্টো পথে হাঁটেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। নিজেদের ভুল স্বীকার কিংবা অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য অনুশোচনা দেখাতে মোটেও প্রস্তুত নন দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব; বরং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার ও জুলাই আন্দোলনের নেতাদের সমালোচনায় যুক্ত হচ্ছেন তারা। আওয়ামী লীগের মূল নেতৃত্বের মনোভাবে এখনো কোনো পরিবর্তন নেই বলে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
খবরটি শেয়ার করুন