ছবি: দ্য উইক
গত ২৯শে অক্টোবর বিশ্বের প্রভাবশালী তিনটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে একযোগে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার তিনটি আলাদা সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। যদিও সেই সাক্ষাৎকারগুলো লিখিত বা ই-মেইল প্রশ্নোত্তরের ভিত্তিতে করা, তারপরও বিষয়টি যে শেখ হাসিনার ‘হোস্ট’ ভারত সরকারের সম্মতিতেই হয়েছে, তা নিয়ে দিল্লিতে পর্যবেক্ষকদের কোনো সন্দেহ নেই বলে মনে করছে বিবিসি বাংলা।
এক প্রতিবেদনে বিবিসি বাংলা গতকাল বুধবার (৫ই নভেম্বর) জানিয়েছে, খুব শিগগিরই আরো কিছু বিদেশি গণমাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একই ধরনের ‘সাক্ষাৎকার’ বেরোবে বলে দিল্লিতে বিবিসি আভাস পেয়েছে। এর মধ্যে আজ বৃহস্পতিবার দ্য উইকে শেখ হাসিনার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য এগুলোতে গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষমা প্রার্থনা করতে অস্বীকৃতি জানান শেখ হাসিনা। তিনি নিজে কোনো কিছুর দায় নেননি, কোনো কিছুর জন্যই অনুশোচনা করেননি। এজন্য সাক্ষাৎকারগুলোর সমালোচনাও আছে।
বিবিসি বাংলার প্রশ্ন, আগামী দিনে কি শেখ হাসিনাকে ‘ইন-পার্সন’ বা সশরীরে মুখোমুখি সাক্ষাৎকার দিতেও দেখা যাবে? সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, শেখ হাসিনাকে মুখ খুলতে দেওযার প্রশ্নে ভারতের পাল্টা বক্তব্য হলো, একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে ও সুরক্ষার প্রয়োজনে তাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে ঠিকই; কিন্তু তিনি কোনো ‘রাজনৈতিক বন্দী’ নন।
এতে বলা হয়, ভারতে রাজনৈতিক বন্দীদের মোবাইল ফোন বা অনলাইন অ্যাক্সেস পাওয়ার ক্ষেত্রেও অনেক বিধিনিষেধ থাকে–কিন্তু শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়, তাছাড়া তার খবরের কাগজ বা টিভি চ্যানেল অবাধে সার্ফ করারও সুযোগ আছে। এমনকী তার ব্যক্তিগত ফোনও প্রথমদিন থেকে তার কাছেই আছে। ‘অতিথি শেখ হাসিনাকে ভারত কী ধীরে ধীরে আনলক করতে দিচ্ছে’ শিরোনামের প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, কয়েক মাস আগেই বিবৃতি দিয়ে ভারত যদিও দাবি করেছে, শেখ হাসিনার বক্তব্য মানেই সেটা দিল্লির বক্তব্য নয়, সব ক্ষেত্রে যে কথাটা সত্যি নয়, তা সুবিদিত। ভারতের পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে বা প্রকাশ্যে যেগুলো বলা সম্ভব নয়, তার অনেক কথাই শেখ হাসিনার মুখ দিয়ে বলানো হচ্ছে–এমনটাই মনে করেন দিল্লিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ তথা জেএনইউ-র সাবেক অধ্যাপক বলদাস ঘোষাল।
ড. ঘোষাল বিবিসিকে বলেন, ‘আমি তো বলব, শেখ হাসিনার এই সাক্ষাৎকারগুলোর মধ্য দিয়ে ভারতই একটু আক্রমণাত্মক অবস্থান নিতে চাইছে। আসলে বাংলাদেশে সম্প্রতি এমন বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে যেটাকে দিল্লি পরিষ্কার ভারত-বিরোধী পদক্ষেপ বলে মনে করছে। যেমন, সে দেশে পাকিস্তানের সামরিক জেনারেল বা সরকারি কর্মকর্তাদের ঘন ঘন সফর–কিংবা ধরা যাক সেভেন সিস্টার্স নিয়ে উসকানিমূলক বক্তব্য।’
দিল্লিতে শীর্ষস্থানীয় থিংকট্যাংক মনোহর পারিক্কর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের (আইডিএসএ) সিনিয়র ফেলো স্ম্রুতি পট্টনায়ক বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণা করছেন বহু বছর ধরে। ড. পট্টনায়কের ধারণা, এই যে ভারত এখন শেখ হাসিনাকে আরও বেশি করে মুখ খুলতে দিচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে সাক্ষাৎকার পর্যন্ত দিতে দিচ্ছে, তার মূলে আছে আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে প্রাসঙ্গিক রাখার চেষ্টা।
প্রসঙ্গত, ২৯শে অক্টোবর একযোগে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারগুলো প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স, এএফপি এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক দৈনিক দ্য ইনডিপেনডেন্ট। সাক্ষাৎকারগুলো নেওয়া হয়েছে ই–মেইলে। সাক্ষাৎকারে সাবেক প্রধানমন্ত্রী গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা হত্যায় তার দায় আছে কী না, আসন্ন সংসদ নির্বাচন, দেশে ফেরা, ট্রাইব্যুনালে তার বিচার এবং রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নিয়ে লিখিত প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। এগুলোই ভারতের জীবনে তার দেওয়া প্রথম সাক্ষাৎকার। ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে ভারতে অবস্থান করছেন শেখ হাসিনা।
রয়টার্সের জন্য ভারতের নয়াদিল্লি থেকে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারটি ই-মেইলের মাধ্যমে নেন সাংবাদিক কৃষ্ণা এন দাস, সরিতা চাগান্তি সিংহ ও ঢাকার রুমা পাল। এএফপির পক্ষ থেকে নয়াদিল্লি থেকে লিখিত সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। তবে প্রতিবেদনে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর কোনো নাম উল্লেখ করা হয়নি। দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টে সংবাদমাধ্যমটির এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মারুশা মুজাফফরের নামে খবরটি প্রকাশিত হয়।
গত ২৩শে অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। এর এক সপ্তাহের মধ্যে শেখ হাসিনার তিনটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার আগে দেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগকে ঘিরে বিদেশি সংবাদমাধ্যমের আগ্রহ বাড়বার কারণ ও উদ্দেশ্য কী, এমন প্রশ্ন সামনে আসছে।
জুলাই অভ্যুত্থানে সহিংস দমন-পীড়ন ও আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুমসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা চলমান। এর আগে ট্রাইব্যুনাল গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর যেকোনো ‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ প্রকাশ বা প্রচার নিষিদ্ধ করে।
খবরটি শেয়ার করুন