ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের খরচ নিয়ে সাবেক ছাত্রনেতা ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক মোশাররফ আহমেদ ঠাকুরের দেওয়া তথ্যটি মিথ্য বলে জানিয়েছে প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) ফ্যাক্ট চেক ও মিডিয়া রিসার্চ টিম বাংলাফ্যাক্ট।
যদিও সরকারি ভাষ্যমতে, কমিশনের মোট বাজেটই ছিল ৭ কোটি টাকা, যার মধ্যে মাত্র ২৩ শতাংশ ব্যবহৃত হয়েছে এবং বাকিটা ফেরত দেওয়া হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার (৬ই নভেম্বর) গণমাধ্যমকে বাংলাফ্যাক্ট জানায়, সম্প্রতি ঐকমত্য কমিশনে ৮৩ কোটি টাকা খরচ হয়েছে বলে একটি টকশোতে তথ্যসূত্রহীন মন্তব্য করেছেন মোশাররফ আহমেদ ঠাকুর। তার সেই প্রমাণহীন মন্তব্যকে আরও বিকৃত করে প্রচার করেছে আওয়ামী প্রপাগান্ডা পেজ ‘আজকের কণ্ঠ’ ও শেখ হাসিনার সাবেক উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন।
নিউজ২৪ চ্যানেলের ‘জনতন্ত্র গণতন্ত্র’ টকশোতে বিএনপির নেতা ও শিক্ষক মোশাররফ আহমেদ ঠাকুর বলেন, ‘মাত্র ৯ মাসে আমি দেখলাম যে বিভিন্ন সোর্স থেকে ৮৩ কোটি টাকার খাওয়া-দাওয়া করেছে… সবাইকে নিয়ে ৮৩ কোটি খাওয়া-দাওয়া করেছেন এবং সেখান থেকে যে বেতন-ভাতা নিয়েছেন…।’
গ্লোবাল টেলিভিশনের ‘প্রশ্নগুলো সহজ’ শীর্ষক টকশোতেও দেখা যায়, মোশাররফ আহমেদ ঠাকুর ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রিয়াজকে উদ্দেশ করে বলছেন, ‘৮৩ কোটি টাকা খরচ করেছেন ৯ মাসে। ৮৩ কোটি টাকা খরচ করে আলী রীয়াজ আপনি পালালেন কেন? আপনি পালালেন কেন?’ স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে, মোশাররফ আহমেদ ঠাকুর ঐকমত্য কমিশনের যাবতীয় কাজের খরচ হিসেবে ৮৩ কোটি টাকার কথা বলেছেন।
তবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বাংলাফ্যাক্টকে জানান, ঐকমত্য কমিশনের মোট বরাদ্দই ছিল ৭ কোটি টাকা, ৮৩ কোটি টাকা নয়। এর মধ্যে প্রায় ২৩ শতাংশ অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে, আর অবশিষ্ট টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দেওয়া হয়েছে। এই ব্যয়ে অন্তর্ভুক্ত ছিল কমিশনের নিরাপত্তা, পরিবহন, খাওয়া-দাওয়া ও অন্যান্য প্রশাসনিক খরচ।
কিন্তু মোশাররফ আহমেদ ঠাকুরের দেওয়া এই ভুয়া তথ্যটিকে আরও বিকৃত করে আশরাফুল আলম খোকন একে ‘খাবারের বিল’ আখ্যা দিয়ে মাসিক খাবারের বিল কত হয়েছে, সে বিশ্লেষণ করে পোস্ট দিয়েছেন। আজকের কণ্ঠ নামক পেজটিও অনুরূপ ‘বিশ্লেষণ’ দিয়ে একটি পোস্ট করে, যা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর পেজ থেকে ঘণ্টায় খাবারের বিল কত উঠেছে, তা নিয়ে পোস্ট দেওয়া হয়।
বাংলাফ্যাক্ট জানায়, গত কয়েক মাস ধরে ‘আজকের কণ্ঠ’ আওয়ামী লীগের প্রোপাগান্ডা পেজ হিসেবে সক্রিয় রয়েছে। বিভিন্ন সময় এই পেজ থেকে ফটোকার্ড তৈরির মাধ্যমে গণমাধ্যমের ছদ্মবেশে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব এবং অপতথ্য ছড়ানো হয়। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেদারল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে পরিচালিত পেজটি নিয়ে বাংলাফ্যাক্ট পূর্বে পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধান চালিয়েছিল।
বাংলাফ্যাক্ট বলছে, ঐকমত্য কমিশনের যাবতীয় কাজের খরচ নিয়ে মোশাররফ আহমেদ ঠাকুরের বক্তব্য যে সত্য নয়, তা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মুনীর হায়দারের দেওয়া তথ্য থেকে স্পষ্ট। মোশাররফ আহমেদ টকশোতে দাবি করেছেন, তিনি ‘বিভিন্ন সোর্স থেকে’ এই তথ্যগুলো পেয়েছেন। কিন্তু সেসব সোর্স কী বা কারা, সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু, তা নিয়ে কিছু বলেননি।
পাশাপাশি, টকশোতে মোশাররফ আহমেদ ঠাকুর অধ্যাপক আলী রীয়াজকে উদ্দেশ্য করে ‘পালালেন কেন’ প্রশ্নও করেছেন। তবে বাস্তবে ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়েছে ৩১শে অক্টোবর। স্বাভাবিকভাবেই অধ্যাপক আলী রীয়াজ আবার ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে তার শিক্ষকতা পেশায় ফিরেছেন, যেখানে তিনি কমিশনের কাজের জন্য ছুটি নিয়েছিলেন। মোশাররফ আহমেদ ঠাকুর এটি ‘পালানো’ হিসেবে উপস্থাপন করে ষড়যন্ত্রতত্ত্বের ইঙ্গিত দিয়েছেন, যা প্রকৃত বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না।
এদিকে মূলধারার গণমাধ্যম কালের কণ্ঠ, ইনকিলাব, আমাদের সময় ইত্যাদি পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে মোশাররফ আহমেদের বক্তব্য হিসেবে ‘নয় মাসে ৮৩ কোটি টাকা খরচ করে আলী রীয়াজ পালালেন কেন’ প্রশ্নটি নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হলে অনেক পাঠক এই বক্তব্যকে ‘তথ্য’ ধরে নিয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছেন।
যেমন, কালের কণ্ঠের ‘নয় মাসে ৮৩ কোটি টাকা খরচ করে আলী রীয়াজ পালালেন কেন—প্রশ্ন মোশাররফ আহমেদের’ শিরোনামের ফটোকার্ড শেয়ার করে একজন লিখেছেন ‘মার্কিন নাগরিক বিদেশ থেকে এসে দেশের জন্য আইন তৈরি করে সেইফ এক্সিট নিয়ে আবার বিদেশ চলে গেলেন।’
আরেকজন মন্তব্য করেছেন, ‘এত টাকা কিভাবে খরচ হলো জনগণকে জানানো উচিত।’ অর্থাৎ একজনের মন্তব্য হিসেবে সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর সেটি থেকেও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।
গত ৮ই আগস্ট ঐকমত্য কমিশনের খরচের ব্যাপারে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বলেন, কমিশন নিজে কোনো খরচ করেনি। ঐকমত্য কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের অধীনে কাজ করে। একে সাচিবিক সহায়তা দেয় আইন মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের ইচ্ছায় সংসদ বিষয়ক সচিবালয়। এ সংক্রান্ত যাবতীয় খরচ নির্বাহ করে এই দুই সচিবালয়।
অর্থাৎ, বাংলাফ্যাক্ট বলছে, ঐকমত্য কমিশন ‘৮৩ কোটি’ টাকা খরচ করেছে বলে যে তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, তা মিথ্যা। পাশাপাশি, এটি ‘খাবারের বিল’ হিসেবে উপস্থাপন করা যে ফটোকার্ড ও পোস্টগুলো সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো হচ্ছে, সেগুলোও অপতথ্য।
খবরটি শেয়ার করুন