ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ আমেরিকায় গেছেন। গত রোববার (২রা নভেম্বর) রাত ৩টার দিকে কুয়েত এয়ার লাইন্সের একটি ফ্লাইটে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান। রাত আড়াইটার দিকে আলী রীয়াজ ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্ট ঢাকার ইমিগ্রেশনে ব্যবহার করেন বলে নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র সুখবর ডটকমকে নিশ্চিত করেছে।
তিনি কেন এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে গেলেন, কবে ঢাকায় ফিরবেন, এসব বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এতোদিন ঢাকায় অবস্থান কালে তার ব্যবহার করা মোবাইল ফোন নম্বরগুলো বন্ধ রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেসবুকে প্রায় সময় সক্রিয় থাকা আলী রীয়াজ এখন তা এড়িয়ে চলছেন।
এর আগে সেপ্টেম্বর মাসে আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রে গেলে সেখানে তার অবস্থানের সময় ঐকমত্য কমিশন সংক্রান্ত যেকোনো তথ্য জানতে কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার ও ঐকমত্য গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। এবার কমিশনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। ফলে বিষয়টি নিয়ে একধরনের লুকোছাপা চলছে বলে নেটিজেনরা অভিযোগ করছেন।
আলী রীয়াজের বিদেশে চলে যাওয়া নিয়ে নানা গুঞ্জন রয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে অনেকে নানা মন্তব্য করছেন তার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া নিয়ে। ঐকমত্য কমিশন গঠনের পর থেকে সরকারের ৮৩ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে উল্লেখ করে অভিযোগ করছেন, টাকার হিসাব না দিয়ে পালিয়ে গেছেন তিনি। কয়েকটি উপায়ে চেষ্টা করেও এ ব্যাপারে সুখবর ডটকম আলী রীয়াজের বক্তব্য জানতে পারেনি।
সাবেক ছাত্রনেতা ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক মোশাররফ আহমেদ ঠাকুরের অভিযোগ, আলী রীয়াজ নয় মাসে ৮৩ কোটি টাকা খরচ করে বিদেশে পালিয়েছেন। আলী রীয়াজ পালালেন কেন, এমন প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। বেসরকারি গ্লোবাল টেলিভিশনের এক টকশোতে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক তাকে জিজ্ঞাসা করলে আপনি কী নিশ্চিত আলী রীয়াজ পালিয়েছেন, মোশাররফ ঠাকুর দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, তার পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি শতভাগ নিশ্চিত।
জানা গেছে, ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়েছে ৩১শে অক্টোবর। স্বাভাবিকভাবেই অধ্যাপক আলী রীয়াজ আবার আমেরিকার ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে তার শিক্ষকতা পেশায় ফিরেছেন, যেখানে তিনি কমিশনের কাজের জন্য ছুটি নিয়েছিলেন। মোশাররফ আহমেদ ঠাকুর এটি ‘পালানো’ হিসেবে উপস্থাপন করে ষড়যন্ত্রতত্ত্বের ইঙ্গিত দিয়েছেন, যা প্রকৃত বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না। টকশোতে তিনি তথ্যসূত্রহীন মন্তব্য করলেও এ বিষয়ে বিভ্রান্ত অনেক নেটিজেন।
মোশাররফ আহমেদ টকশোতে দাবি করেছেন, তিনি ‘বিভিন্ন সোর্স থেকে’ এই তথ্যগুলো পেয়েছেন। কিন্তু সেসব সোর্স কী বা কারা, সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু, তা নিয়ে তিনি কিছু বলেননি। ঐকমত্য কমিশনের যাবতীয় কাজের খরচ নিয়ে মোশাররফ আহমেদ ঠাকুরের বক্তব্য খণ্ডন করে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার গণমাধ্যমে আজ বৃহস্পতিবার (৬ই নভেম্বর) বক্তব্য দিয়েছেন। ঐকমত্য কমিশনের মোট বরাদ্দই ছিল ৭ কোটি টাকা, ৮৩ কোটি নয়। এর মধ্যে প্রায় ২৩ শতাংশ অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে, আর অবশিষ্ট টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দেওয়া হয়েছে।
সূত্র বলছে, আলী রীয়াজের প্রতি দেশের অন্যতম প্রধান বিএনপিসহ সমমনা ছোট কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সন্দেহ বেড়েছে। ২০২৪ সালের ৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের পর তিনি কোনো 'মিশন' নিয়ে, বা বিদেশ থেকে কোনো গোষ্ঠীর 'উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে' দেশে এসেছেন কী না, তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন দলগুলোর নীতিনির্ধারকেরা। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এসব দল বিএনপির জোটসঙ্গী হতে আগ্রহী।
সংস্কার বাস্তবায়ন নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের প্রতিক্রিয়া জানানো নিয়ে বিএনপিকে এখন যে পরিকল্পিতভাবে উভয়সংকটের মুখোমুখি করা হয়েছে, এর পেছনে গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে করছে দলগুলো। ড. রীয়াজের কার্যক্রম, গতিবিধি নতুন করে পর্যবেক্ষণ করছে তারা। ঐকমত্য কমিশনের শীর্ষ পদে বসে দেশি-বিদেশি বিএনপি বিরোধী কোনো গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে আলী রীয়াজের যোগসাজশ আছে কী না, এর তত্ত্বতালাশ করছে তারা। রাজনৈতিক দলগুলোর এই মনোভাব টের পেয়ে আগেভাগেই আমেরিকা চলে গেছেন তিনি।
আরেকটি সূত্র জানায়, চব্বিশের অভ্যুত্থানের পর নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন এবং ঐকমত্য কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব পালনের সুবাদে ড. রীয়াজ রাজনীতির সংকটময় মুহূর্তে অন্যতম কেন্দ্রীয় ভূমিকায় থেকে বিশেষ বাস্তবতাকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। সেজন্য দলগুলো তার প্রতি প্রথম দিকে একধরনের আস্থা রাখলেও এখন তার দিকে নানা সন্দেহের তীর। ঐকমত্য কমিশন বিএনপির সঙ্গে 'প্রহসন' বা 'প্রতারণা' করেছে বলে বিভিন্ন দলের অভিযোগ। এসব কারণে অভিমান করে আলী রীয়াজ নিজের ঠিকানায় ফিরে গেছেন।
এদিকে আলী রীয়াজের নতুন বই ‘অ্যা ফ্র্যাকচারড পাথ: চ্যালেঞ্জেস অব ডেমোক্রেটিক ট্রানজিশন ইন বাংলাদেশ’ প্রকাশিত হয়েছে। গত মাসে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল) বইটি প্রকাশ করেছে। ইউপিএলের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয় গত ৩১শে অক্টোবর। বইটির খবর জানিয়েও নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে কোনো পোস্ট করেননি তিনি। বই প্রকাশ হলে সাধারণত তিনি নিজের ফেসবুক পোস্টে তা পাঠক, বন্ধুদের জানান। তার সবশেষ ফেসবুক পোস্টও নিজের বই বিষয়ক। যা দিয়েছিলেন চলতি বছরের ১৮ই ফেব্রুয়ারি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে ড. রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তিনি আটলান্টিক কাউন্সিলের নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের (এআইবিএস)-এর প্রেসিডেন্ট। তিনি বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিক বলেও অভিযোগ আছে। ড. ইউনূসের সরকারের আমলে তিনি দেশের সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
খবরটি শেয়ার করুন