ছবি: সংগৃহীত
এক হতে যাওয়া দুর্বল পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গতকাল (৫ই নভেম্বর) বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে এসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদ শূন্য ঘোষণা করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের পর প্রতিটি ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে প্রশাসকরা গতকালই যোগদান করেছেন। এর মাধ্যমে এক্সিম, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংক একীভূতকরণের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হলো।
এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আপাতত ব্যাংকগুলো সরকারি মালিকানায় এসেছে। এসব ব্যাংকের সব শেয়ার শূন্য হবে। এ পর্যায়ে কোনো কর্মীর চাকরি যাবে না। যিনি যে কাঠামোতে বেতন পাচ্ছেন, তাই পাবেন। আমানতকারীদের উদ্দেশে গভর্নর বলেন, ‘প্রত্যেকের আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ। ফলে কেউ প্রয়োজন ছাড়া আমানত উত্তোলন করবেন না।’
সংবাদ সম্মেলনের আগে গতকাল দুপুরে পাঁচ ব্যাংকের চেয়ারম্যানদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এক বৈঠকে পর্ষদ বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত জানান গভর্নর। পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে সোশ্যাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংকে নিয়মিত এমডি রয়েছেন। প্রশাসকের কাছে তাদের পদত্যাগ করতে বলা হয়।
গভর্নরের সংবাদ সম্মেলনের পর গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ব্যাংক খাতে সুশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাসহ সামগ্রিক শৃঙ্খলা আনা এবং আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষাসহ জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশের ক্ষমতাবলে পাঁচটি ব্যাংককে রেজল্যুশন বা নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ার আওতায় আনা হলো।
একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে গত সরকারের আমলে চারটি ছিল এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। আর ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির সাবেক চেয়ারম্যান ও নাসা গ্রুপের মালিক নজরুল ইসলাম মজুমদারের নিয়ন্ত্রণে ছিল এক্সিম ব্যাংক। এস আলম গ্রুপ ও এর প্রধান সাইফুল আলম এবং নজরুল ইসলাম মজুমদারদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা হয়েছে। নজরুল ইসলাম মজুমদার বর্তমানে কারাগারে আটক। অন্যদিকে সাইফুল আলম দেশে নেই।
গত সরকারের সময়ে এসব ব্যাংকে বড় ধরনের অনিয়ম ও জালিয়াতির কারণে উচ্চ খেলাপি ঋণ, ব্যাপক মূলধন ঘাটতি এবং তারল্য সংকট তৈরি হয়। ব্যাংকগুলো অনেকদিন ধরে আমানতকারীদের অর্থ ঠিকমতো ফেরত দিতে পারছে না। এসব ব্যাংকে ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার বিশেষ ধার দিয়েছে। এসব ব্যাংকে আমানতকারীর সংখ্যা ৭৫ লাখ।
সংবাদ সম্মেলনে যা বললেন গভর্নর
বাংলাদেশ ব্যাংকের সভাকক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গভর্নরের সঙ্গে চার ডেপুটি গভর্নর, ব্যাংকগুলোতে প্রশাসকরাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। গভর্নর বলেন, একীভূতকরণের কাজ পুরোপুরি শেষ হতে এক থেকে দুই বছর লাগতে পারে। এসব ব্যাংকের আর্থিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সরকার নিলেও পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ হবে বেসরকারি ব্যাংকের আদলে।
আমানতকারীদের উদ্দেশে আহসান মনসুর বলেন, সরকার দায়িত্ব নেওয়ায় ব্যাংকগুলোর আমানত নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কেউ যেন অপ্রয়োজনীয় অর্থ উত্তোলনের চেষ্টা না করেন। বিশ্বের সবচেয়ে ভালো ব্যাংক থেকেও সবাই টাকা তোলার জন্য লাইন ধরলে ওই ব্যাংক টাকা দিতে পারবে না।
তিনি বলেন, একীভূতকরণ কার্যকরের দিন থেকেই এসব ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে বাজারভিত্তিক মুনাফা দেওয়া হবে। ফলে কেবল সুদের কারণে কেউ টাকা তুলবেন না। এরপরও ব্যাপক অর্থ উত্তোলন ঠেকাতে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দুই লাখ টাকার বেশি আমানত উত্তোলনের একটি সময়সীমা দেওয়া হবে। সরকারি গেজেটের মাধ্যমে যা জানানো হবে। তবে যেসব আমানতকারীর দুই লাখ টাকা বা তার কম রয়েছে, তারা চাইলে চলতি মাসেই সম্পূর্ণ অর্থ উত্তোলন করতে পারবেন।
গভর্নর বলেন, একীভূত হওয়ার পর নতুন ব্যাংকটি হবে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ইসলামী ব্যাংক। সেভাবেই পরিচালনা পর্ষদ ও এমডি নিয়োগ হবে। এর আগে ইস্টার্ন ব্যাংক একীভূতকরণের সময় যেসব আমানতকারী শেয়ার পেয়েছিলেন তারা সবাই লাভবান হয়েছেন। এসব ব্যাংকের যেসব আমানতকারী শেয়ার পাবেন তারাও অনেক লাভবান হবেন।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের পর রাজনৈতিক সরকার একীভূতকরণ প্রক্রিয়া এগিয়ে নেবে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে গভর্নর বলেন, যে সরকারই আসুক, তাদের স্বার্থেই এগিয়ে নিতে হবে। জনগণ, দেশ এবং আর্থিক খাতের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য ব্যাংকগুলো একীভূত করা হচ্ছে। এর সফল বাস্তবায়ন আগামী সরকারের জন্য বড় ধরনের ইতিবাচক স্থিতিশীলতা আনবে এবং অর্থনীতিতে আস্থা পুনর্গঠনে সহায়ক হবে। ফলে এগিয়ে না নেওয়ার কিছু তিনি দেখেন না। তবে একীভূতকরণ প্রক্রিয়া বেশ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ।
শেয়ার শূন্য হবে
একীভূত হতে যাওয়া পাঁচটি ব্যাংকই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। ব্যাংকের অর্ধেকের মতো শেয়ার স্পন্সর উদ্যোক্তাদের হাতে। বাকি অর্ধেক পুঁজিবাজারের প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের হাতে।
শেয়ারহোল্ডারদের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার আলোকে এসব ব্যাংকের শেয়ার শূন্য হবে। কোনো ব্যাংকের নিট সম্পদ মূল্য ঋণাত্মক হলে সেই ব্যাংকের শেয়ার থেকে পাওয়ার কিছু নেই। তিনি বলেন, বাজার থেকে শেয়ারহোল্ডাররা ঝুঁকি নিয়েই শেয়ার কিনেছেন। অনেক দেশে নিট সম্পদ মূল্য ঋণাত্মক হলে শেয়ারহোল্ডারদের উল্টো টাকা দিতে হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক সেদিকে যাচ্ছে না। ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশে সব শেয়ার শূন্য করার কথা বলা হয়েছে।
প্রশাসক কারা
এক্সিম ব্যাংকের প্রশাসক নিযুক্ত হয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শওকাতুল আলম। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে আরেক নির্বাহী পরিচালক সালাহ উদ্দিনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে নির্বাহী পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান দিদার প্রশাসক নিযুক্ত হয়েছেন। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক মো. মোকসুদুজ্জামান এবং ইউনিয়ন ব্যাংকে আরেক পরিচালক মোহাম্মদ আবুল হাসেমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, গতকালই পাঁচ ব্যাংকের প্রশাসকরা বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে বৈঠক করেন। সেখানে তারা প্রাথমিক দিকনির্দেশনা দেন।
সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর বলেন, ‘অস্থায়ী প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে ব্যাংক একীভূতকরণের একটি পর্যায় আমরা পার হলাম। তাদের সহায়তার জন্য প্রতিটি ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আরও চারজন করে কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয়েছে। তারা মূলত চারটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন। প্রথমত– ব্যাংকগুলোর এলসি খোলাসহ দৈনন্দিন ব্যবসায়িক কার্যক্রম সচল রাখা। দ্বিতীয়ত– তথ্যপ্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানো ও নিরাপদ রাখার ব্যবস্থা। তৃতীয়ত– মানবসম্পদের মূল্যায়ন। চতুর্থত– একই এলাকায় একাধিক শাখা থাকলে বন্ধ করে দূরবর্তী এলাকায় স্থাপনের ব্যবস্থা।
নাম হবে সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ ব্যাংক মিলে নতুন ব্যাংকের নাম হবে সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক। নতুন ব্যাংক আপাতত সরকারি মালিকানায় থাকবে। এক পর্যায়ে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হবে। এর মূলধন হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা দেবে সরকার। আর আমানতকারীদের তাদের আমানতের বিপরীতে ১৫ হাজার কোটি টাকার শেয়ার দেওয়া হবে। এসব ব্যাংকে আমানতকারীর বর্তমানে জমা আছে এক লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে ঋণ রয়েছে এক লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এক লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা বা ৭৬ শতাংশ এখন খেলাপি। সারাদেশে এসব ব্যাংকের ৭৬০টি শাখা, ৬৯৮টি উপশাখা, ৫১১টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট এবং ৯৭৫টি এটিএম বুথ রয়েছে।
জে.এস/
খবরটি শেয়ার করুন