বুধবার, ২৫শে জুন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১০ই আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকার বিরুদ্ধে ‘ইসরায়েল-প্রীতির’ অভিযোগের ভিত্তি কী

নিজস্ব প্রতিবেদক

🕒 প্রকাশ: ১১:৪৪ অপরাহ্ন, ২৪শে জুন ২০২৫

#

ছবি: সংগৃহীত

ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা 'ঢাকা ট্রিবিউন' এর বিরুদ্ধে ইসরায়েল ও ধর্মীয় বিচারে এর সংখ্যাগুরু জনগণ ইহুদিদের 'পক্ষ' নেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন একশ্রেণির নেটিজেন। গত ১৩ই জুন ইরানে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলে ইরান পাল্টা হামলা চালালে শুরু হওয়া সংঘাতের সময় (আপাতত 'যুদ্ধবিরতি', আজ মঙ্গলবার ২৪শে জুন থেকে) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তারা এ অভিযোগ তুললেন পত্রিকাটির বিরুদ্ধে।

ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনে ভারতী গোয়েন্দা সংস্থা 'রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের' (র) কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিগত আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের কর্মকর্তাও ঢাকায় ছিলেন। তাদের পরামর্শে 'ঢাকা ট্রিবিউন' নিজেদের প্রচারিত একটি চিত্রকর্মের বিষয়ে ইহুদিদের অনুভূতির কথা চিন্তা করে দুঃখ প্রকাশ করেছে বলে নেটিজেনদের মধ্যে অভিযোগ চলছে। তারা পত্রিকাটিকে সাবেক 'ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সরকারের সহযোগী'ও বলছেন।

জানা গেছে, ২০১৩ সালের নভেম্বরে ঢাকা ট্রিবিউনে  প্রকাশিত একটি চিত্রকর্ম 'বিতর্ক' জন্ম দেয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। চিত্রকর্মটি পাঠকমহলে প্রশংসিত হলেও কেউ কেউ অভিযোগ করেন, এতে অ্যাডলফ হিটলারের কায়দায় 'নাৎসি স্যালুট' ঠাঁই পেয়েছে। বিভ্রান্তি  ও বিতর্ক দূর করতে প্রগতিশীল মতাদর্শে বিশ্বাসী ঢাকা ট্রিবিউন এ বিষয়ে ২০১৩ সালের ১লা ডিসেম্বরে একটি ব্যাখ্যা ছাপায়। চিত্রকর্মটি ছিল বাংলাদেশের পতাকার সামনে নাগরিকদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতিজ্ঞা করার।

প্রকাশিত চিত্রকর্মের মাধ্যমে কোনো জনগোষ্ঠীর অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া পত্রিকাটির উদ্দেশ্য নয় বলে ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়। মূলত কার্টুনটি নিয়ে ঢাকা ট্রিব্রিউনের দেওয়া সেই ব্যাখ্যাকে ভিত্তি করেই সম্প্রতি নির্দিষ্ট মতাদর্শের নেটিজেনদের দাবি, পত্রিকাটি 'ইহুদিপন্থী'। দেশে একজন ইহুদি না থাকলেও ওই ঘটনার মধ্য দিয়ে বিষয়টি 'প্রমাণিত' বলেও তাদের দাবি।

ঢাকা ট্রিবিউনের সেই ব্যাখ্যার লিংক ফেসবুকে শেয়ার করে শিহাবুল ইসলাম নামের একজন দাবি করেন, '২০১৩ সালে ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট সরকার। সেই সময় ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকার কার্টুনে নাৎসি স্যালুট বোঝানো হয়েছিল কী না, বিষয়টি দেশের কারো নজরে পড়েনি। বরং বিষয়টি নজরে পড়েছিল ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের র-মোসাদের লোকদের। তারাই ঢাকা ট্রিবিউনের কাছে অভিযোগ করলে পত্রিকাটি দুঃখ প্রকাশ করে ইহুদিদের পক্ষ নেয়। পত্রিকাটি ইহুদিপন্থী।'

শিহাবুল নামের ওই ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দাবি করা বিষয়টির সত্যতা যাচাই না করে, কিংবা বক্তব্যের পক্ষে তথ্য-উপাত্ত না চেয়ে 'গনগড়া মন্তব্য' করেন অনেকে। তারা পত্রিকাটিকে 'অভিযুক্ত' করছেন ফেসবুকে। সাঈদ আজমল নামের একজন লেখেন, 'ঢাকা ট্রিবিউন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হলেও এটা জায়নিস্টদের মুখপত্র। ইসলামপন্থী ও মুসলমানদের বিরোধী।' সাইমন সাদি নামের একজন লেখেন, 'ইসলাম বিদ্বেষী মিডিয়া আসলে ভারত ও ইসরায়েলপন্থী।'

গত ১৩ই জুন ইসরায়েল ইরানে হামলা চালানোর পরিপ্রেক্ষিতে ইরান ইসরায়েলে হামলা করে। এরপর ১২ দিন ধরে চলে দেশ দুটির মধ্যে যুদ্ধাবস্থা। একপর্যায়ে আমেরিকাও ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে ইরানে হামলা চালায়। গত ১২ দিন দেশের জাতীয় পর্যায়ের অন্য সংবাদমাধ্যমগুলোর মতো ঢাকা ট্রিবিউনও গুরুত্বের সঙ্গে এসব বিষয়ে প্রতিবেদন, কলাম, সম্পাদকীয় ও বিশ্লেষণ প্রকাশ করে। এসব লেখা পর্যালোচনা করে জায়নবাদের পক্ষে পত্রিকাটির সাংবাদিকতাকে অভিযুক্ত করার কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

২০১৩ সালের ১লা ডিসেম্বরে 'এক্সপ্ল্যানেশন অন এন ইলাস্ট্রেশন' শিরোনামে দেওয়া ব্যাখ্যায় পত্রিকাটি বলে, ওই বছরের ২৯শে নভেম্বর, শুক্রবার ঢাকা ট্রিবিউনের উইকএন্ড ম্যাগাজিনের ‘বাংলাদেশি রাজনীতির উন্নতির ১০টি উপায়’ শিরোনামে একটি লেখার সঙ্গে যে চিত্র প্রকাশিত হয়েছে, তা প্রচুর প্রশংসা অর্জন করলেও কিছু বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছে। কারণ, অনেকে কার্টুনের অঙ্গভঙ্গিগুলোকে ‘নাৎসি স্যালুট’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। ঢাকা ট্রিবিউনের এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি এবং প্রচার করার কোনো উদ্দেশ্য নেই।

জানা যায়, জায়নবাদের পক্ষে সাংবাদিকতা বলতে বোঝায় জায়নবাদী আদর্শ ও ইসরায়েলের সমর্থনে সংবাদ পরিবেশন করা। এটি সাধারণত ইহুদি জাতীয়তাবাদের একটি রূপ এবং ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষাকে সমর্থন করে। এ ধরনের সাংবাদিকতা ইসরায়েলের নীতি ও কার্যক্রমের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিকে সমালোচনা করে। এককথায় জায়নবাদের পক্ষে সাংবাদিকতা বলতে বোঝায়, এ মতাদর্শের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে ইসরায়েলের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করা।

জাতিসংঘে নিযুক্ত আমেরিকার একসময়কার রাষ্ট্রদূত এবং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে সাময়িক সময়ের জন্য জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদে থাকা জন বোল্টন ২০১৫ সালে নিউইয়র্ক টাইমসে একটি মতামত কলামে লিখেছিলেন, ‘ইরানের বোমা থামাতে হলে, ইরানেই বোমা ফেলতে হবে।’ আমেরিকার সবচেয়ে প্রভাবশালী সংবাদপত্র যখন আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘনের পক্ষে এমন একটি প্রকাশ্য আহ্বান ছাপায়, তখন তা স্পষ্ট করে দেয়, ইরান-ফিলিস্তিনকে আমেরিকা ও তাদের গণমাধ্যমে কতটা ভয়ংকর ও শত্রু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। যা জায়নবাদের পক্ষে সাংবাদিকতার অংশ।

ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর 'নিরপেক্ষতার ভান ধরা' পশ্চিমা গণমাধ্যম ও সংবাদপত্রগুলোর চরিত্র আবার পরিষ্কার ওঠে গোটা বিশ্ববাসীর কাছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমের হামাসকে একতরফা দোষারোপ আর ইসরায়েলের প্রতি নির্লজ্জ পক্ষপাতে আরেকবার বিস্মিত হয় বিশ্ববিবেক। সবশেষ ইসরায়েল ও ইরানের সংঘাত নিয়েও পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো একতরফা 'আচরণ' করে। গণমাধ্যমগুলো শুধু ইসরায়েলের বয়ান তুলে ধরে। সেসব প্রতিবেদনে ইরানের ন্যায্যতার কথা নেই। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর পক্ষপাতিত্ব ও অর্থের বিনিময়ে এজেন্ডা বাস্তবায়নের এমন নজির অনেক পুরোনো।

ঢাকা ট্রিবিউন

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন