ছবি: সংগৃহীত
দেশের জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে প্রতিবেদন প্রকাশ-প্রচারের পর 'অদৃশ্য চাপে' তা মুছে ফেলার ঘটনা বাড়ছে। গত এক বছরের মধ্যে, বিশেষ করে গত বছরের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন বাস্তবতায় এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে বলে সাংবাদিক সমাজের অভিযোগ। দৈনিক প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের মতো প্রভাবশালী, ইত্তেফাকের মতো প্রাচীন এবং বেসরকারি ইনডিপেনডেন্টের মতো দর্শকনন্দিত টিভি চ্যানেলে প্রতিবেদন প্রকাশিত-প্রচারিত হওয়ার পর মুছে ফেলা ও সম্পাদনা করা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ আলোচিত-সমালোচিত ঘটনা।
এসব ঘটনা স্বাধীন সাংবাদিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাশাপাশি পাঠক-দর্শকদের মধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। কেন, কী কারণে, বা কোন শক্তির চাপে প্রতিবেদন পরে 'সরিয়ে' দেওয়া হয়, এমন প্রশ্ন অনেকের। সবশেষ কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া ছাড়াই আজ সোমবার দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণ ও ই-পেপার থেকে বেশ কয়েক ঘণ্টার জন্য মুছে ফেলার ঘটনা ঘটে। পরে সমালোচনার মুখে প্রতিবেদনটি ই-পেপারে আবার আপ হয়। প্রতিবেদনটি ছিল 'তদন্তে নেমেছে দুদক: ফ্যাসিস্টের দোসরের হাতে ৩শ কোটি টাকার প্রকল্প' শিরোনামের।
বিষয়টি পাঠক ও নেটিজেনদের নজরে আনেন প্রবাসী ও জনপ্রিয় দুই সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের সামি এবং জাওয়াদ নির্ঝর। তারা দুজন সোমবার বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিলে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানী ওই দুই প্রবাসী সাংবাদিক কিছু অভিযোগও করেন। জাওয়াদ নির্ঝরের অভিযোগ, '৩০ লাখ টাকা খেয়ে প্রতিবেদনটি সরানো হয়েছে।প্রতিবেদনটি সরাতে সক্রিয় হন একজন উপদেষ্টা (অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের)।' সেই উপদেষ্টার নাম তিনি পোস্টে উল্লেখ করেননি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো পত্রিকা, টিভি চ্যানেলে প্রতিবেদন সংবাদ প্রচারিত হলে এর সংশোধন ও সম্পাদনা করা যায়। এটা দুনিয়াজুড়ে সাংবাদিকতায় চর্চিত ও স্বীকৃত রীতি। তবে এ বিষয়ে পাঠক-দর্শকের কাছে ব্যাখ্যা দেওয়া অবশ্যই জরুরি। কারণ, যে কোনো সংবাদমাধ্যম পাঠক-দর্শকের কাছে দায়বদ্ধ। কোনো ব্যাখ্যা ছাড়া সংবাদ 'ব্ল্যাক আউট করা' করা সাধারণত ভয়ের সাংবাদিকতার সংস্কৃতি। আবার সংবাদে অভিযুক্ত পক্ষের সঙ্গে 'আপসরফার' পর তা মুছে ফেলাও কোনোভাবেই সৎ সাংবাদিকতা হতে পারে না।
জানতে চাইলে দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী নিজের সাংবাদিকতা–জীবনে মামলা, হামলা ও জেল খাটার কথা তুলে ধরে বলেন, কোনো সরকারের আমলেই তিনি ভালো ছিলেন না। প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস মন খুলে লিখতে বলেছেন। এটা আশার কথা। কিন্তু সাংবাদিকরা কী লিখতে পারছেন—এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, সাংবাদিকরা সেলফ সেন্সরশিপ থেকে বের হতে পারছেন না। এখান থেকে বের হতে না পারলে যাত্রাটা কঠিন হবে।
তবে কিছুসংখ্যক সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের ভূমিকারও সমালোচনা করেন মতিউর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, ভারতে যদি ‘গদি সাংবাদিক’ হয়, বাংলাদেশে হবে ‘তেলবাজ সাংবাদিক’। তিনি বলেন, অনেক সাংবাদিক বেতন পান না এটা যেমন ঠিক, আবার অনেকের বেতন প্রয়োজন হয় না, এটাও স্বীকার করতে হবে। এ দুর্নীতির বিরুদ্ধেও কথা বলতে হবে। আমাদের আত্মসমালোচনাও করা উচিত।
কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের সামি পোস্টে বলেন, 'আওয়ামী সরকার যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল, তখন প্রায়ই প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) পাবলিক রিলেশন্স মনিটরিং সেল (পিআরএমসি) ব্যবহার করে বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে প্রকাশিত সংবাদ—যা তাদের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তা সরিয়ে ফেলা হত, বা বলা যায় একপ্রকারের বাধ্য করা হত। একই প্রবণতা আবারো শুরু হয়েছে, কিন্তু জানা গেছে, পিআরএমসি এ কাজটি করছে না, বর্তমানে কাজটি করছেন অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে থাকা কতিপয় ব্যক্তি।'
তিনি বলেন, ''তারা প্রায়শই বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে ফোন করে হুমকি দিয়ে, সংবাদ-প্রতিবেদন সরিয়ে ফেলতে বলেন। আর না হলে ফ্যাসিবাদের দোসর এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরোধী শক্তি বলে ট্যাগ দেন। অনেক ক্ষেত্রে পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করে দেওয়া হবে বলে শাসানো হয়েছে—এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে। এই যেমন আজকের যুগান্তরের প্রতিবেদন 'ফ্যসিস্টের দোসরের হাতে ৩শ কোটি টাকার প্রকল্প' শিরোনামে ছাপানো রিপোর্টটি প্রিন্ট ভার্সনে পাওয়া গেলেও, অনলাইন থেকে মুছে ফেলতে বাধ্য করা হয়েছে।''
সাংবাদিক জাওয়াদ নির্ঝর লেখেন, 'ফ্যাসিস্টের দোসরদের হাতে ৩শ কোটি টাকার প্রকল্প! তদন্তে নেমেছে দুদক। এ সংবাদ আজ যুগান্তর পত্রিকা তাদের শেষ পাতায় ছেপেছিল। এরপর প্রতিবেদনটি সরাতে সক্রিয় হন একজন উপদেষ্টা। যাদের বিরুদ্ধে নিউজ, তারা বড় একটি অংকের টাকা দেয় যুগান্তরের উপরের মহলকে। উপরের মহল মানে সম্পাদক পর্যন্ত। অভিযোগ আছে, ৩০ লাখ টাকায় রফা-দফা হয়েছে।'
তিনি লেখেন, 'এরপর নিউজটি তাদের অনলাইন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ই-পেপারে থাকা নিউজটি সরিয়ে দিয়ে সেখানে ফাকা রাখা হয়। যা ছবিতে (তার ফেসবুক পোস্টে) দেওয়া আছে। এভাবেই ভালো ভালো রিপোর্টগুলো খেয়ে দেওয়া হয়। প্রচারের পরও খেয়ে দেওয়া হয়। যুগান্তর, আপনারা নতুন সম্পাদকের আন্ডারে এসব কাজ নিয়মিতই করে আসছেন।'
অবশ্য সোমবার রাত সাড়ে আটটার পর যুগান্তর ওই প্রতিবেদন ই-পেপারে আবার যোগ করে। এ বিষয়ে পরে সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের ফেসবুকে আরেকটি পোস্ট দিয়ে বলেন, 'এর আগের পোস্টটির কারণে পুনরায় ই-পেপারে যুগান্তরের প্রতিবেদনটি আপ করা হয়েছে।' এ বিষয়ে জাওয়াদ নির্ঝর বলেন, 'ই-পেপারে (যুগান্তর) নিউজ আপ করেছে। কিন্তু অনলাইনে করেনি। অনলাইনে করার ইচ্ছাও নেই কর্তৃপক্ষের।'
যোগাযোগ করলে নিউ এজের সম্পাদক নূরুল কবীর এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পত্রিকার সম্পাদকদের এখন আর আওয়ামী জমানার মতো বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সাংবাদিকতা সম্পর্কে নসিহতমূলক বার্তা গ্রহণ করতে হয় না।’ তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক সাইফুল আলম চৌধুরী মনে করেন, 'গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অটোক্রেসির হাত থেকে এসে মবোক্রেসির দৌরাত্ম্যে পড়েছে। আগে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করত, এখন মব তৈরি করে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। মবের মাধ্যমে গণমাধ্যমকে ভয় দেখানো হচ্ছে। সরকার সেটি দেখেও না দেখার ভান করছে।’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এ সময়ে সংবাদমাধ্যমের ওপর সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থার ‘হস্তক্ষেপ বন্ধ’ হলেও ‘মবের’ হুমকির নতুন প্রবণতা দেখার কথা বলেছেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদও। তিনি বলেন, ‘মবের হুমকির’ কারণে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো এক ধরনের সংশয়ে আছে; ফিরে এসেছে ‘সেল্ফ সেন্সরশিপ’। রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংস্কারে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার যেসব সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, এর মধ্যে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের নেতৃত্বে ছিলেন কামাল আহমেদ।
খবরটি শেয়ার করুন