শুক্রবার, ২০শে জুন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৬ই আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কারাবন্দী ও মামলার শিকার সাংবাদিক

তদন্তের অগ্রগতি ও বিচারপ্রক্রিয়ার গতির দায় কার?

নিজস্ব প্রতিবেদক

🕒 প্রকাশ: ০৭:১৩ অপরাহ্ন, ১৯শে জুন ২০২৫

#

ছবি: সংগৃহীত

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের মিলিয়ে অন্তত ২৬৬ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যা চেষ্টা ও গোলাগুলির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে মামলা দায়ের হয়েছে। ১৩ সাংবাদিক গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। এসব মামলার বিচারক কার্যক্রম ঠিকমতো পরিচালিত হচ্ছে না বলে অভিযোগ সাংবাদিক সমাজের। কোনো কোনো সাংবাদিক বলছেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এতো মামলা দায়েরের ‘রেকর্ড’ এবং গত দশমাসেও সেগুলোর তদন্তের অগ্রগতি না হওয়ার দায় আইন মন্ত্রণালয় ও এর দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও তার মন্ত্রণালয়ের।

তাদের মতে, উপদেষ্টাদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টনের দিকে তাকালে বর্তমান সরকারের ‘বিশৃঙ্খলার চিত্র’ স্পষ্ট হয়। আইন এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় একজনের কাঁধে ন্যস্ত হওয়ার ফল হচ্ছে দেশে সাংবাদিকরা হত্যা মামলার আসামি এবং আইনি ব্যবস্থা পরিণত হয়েছে নাগরিকদের হয়রানি, ভয় দেখানো ও অর্থ আদায়ের অস্ত্রে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক্ষেত্রে তৎপরতা নেই। অনেকে মনে করেন, বিষয়টির দায় শুধু আইন বা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাঁধে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, এটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন পুরো উপদেষ্টা পরিষদের সম্মিলিত অবস্থান।

সাংবাদিক সমাজের একাংশ বলছে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এসব মামলা হয়তো সরাসরি সরকারের নয়, বরং রাজনৈতিক দল বা অন্য রাজনৈতিক চরিত্রের সহায়তায় দায়ের করা হয়েছে। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে একাধিক বার বলা হয়েছে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সরকারের কেউ মামলা দায়ের করেননি। সাংবাদিক সমাজের আরেক অংশ বলছে, যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ও কারাগারে আছেন, তারা আওয়ামী লীগের গত সরকারের শাসনামলে নানাভাবে সরকারের সঙ্গে যুক্ত এবং সুবিধাভোগী ছিলেন।

এ অংশের মতে, কারাবন্দী ও মামলার শিকার সাংবাদিকরা অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন। ওই সরকারের বিরোধী দল দমন, নির্বাচনে জালিয়াতি, গুম, সংবাদমাধ্যমকে চুপ করিয়ে রাখা ও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে অন্যায়ভাবে মানুষকে আটক রাখার কর্মকাণ্ডে তারা রাজনৈতিক আনুগত্য দেখিয়েছেন। তারা কর্তৃত্ববাদী শাসনের কট্টর সমর্থক বা প্রচারক ছিলেন তারা। গত বছরের জুলাই-আগস্টে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন বা এতে সমর্থন করেছেন তারা। সাংবাদিক সমাজের এ অংশও চাই, মামলাগুলোর তদন্ত দ্রুত হওয়ার পাশাপাশি অভিযুক্তদের যেন যথাযথ সাজা হয়।

ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান অনেক বছর ধরে আইসিটির বিচার কার্যক্রম ও বাংলাদেশ নিয়ে লিখছেন। তিনি মনে করেন, তাদের (কারাবন্দী সাংবাদিক) বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ অবশ্যই থাকতে পারে। সাংবাদিক ও সম্পাদক শাকিল আহমেদ ও মোজাম্মেল বাবু গত ২৩শে জুলাই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর (ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা) সঙ্গে এডিটরস গিল্ডের এক বৈঠকে আন্দোলনকারীদের নিয়ে উসকানিমূলক মন্তব্য করেছেন, এমন রেকর্ডও রয়েছে। এ ধরনের বক্তব্যের কিছু অংশ ধাক্কা খাওয়ার মতো ছিল। তবে রাজনৈতিক আনুগত্য কিংবা কোনো কর্তৃত্ববাদী শাসনের কট্টর সমর্থক বা প্রচারক হওয়াটাই অপরাধ নয়।

সম্পাদক পরিষদ বলছে, যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করে অভিযুক্ত সাংবাদিকদের কোনো সংশ্লিষ্টতা না পাওয়া গেলে এসব মামলা থেকে দ্রুত তাদের অব্যাহতি দেওয়া উচিত। সাংবাদিকরা অপরাধ করে থাকলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে যথাযথ ধারা অনুসরণ করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। যে সাংবাদিকরা গত সরকারের নানা নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ডে সাংবাদিকতার নামে সমর্থন দিয়েছেন, প্রেস কাউন্সিলে কমিটি গঠন করে দোষী সাব্যস্ত হলে কাউন্সিলের আইনে তাদের সাজা হতে পারে। কাউন্সিলের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রচলিত আইনে তাদের বিচার চলতে পারে।

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের সময় সহিংসতার অভিযোগে আওয়ামী লীগপন্থী হিসেবে পরিচিত অনেক সাংবাদিক দীর্ঘদিন ধরে প্রমাণ ছাড়া আটক রয়েছেন। এ ধরনের আটক ও জামিন না পাওয়ায় বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও সরকারের সংস্কার প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পুলিশ মামলা নেওয়ার বা গ্রেপ্তারের আগে কোনো ধরনের তদন্তের চেষ্টা পর্যন্ত করেনি। তারা দশমাসের মধ্যেও আদালতে এমন কোনো নতুন প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি, যা এ নির্দিষ্ট অভিযোগগুলোর সঙ্গে সাংবাদিকদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে। প্রশ্ন উঠেছে, এর দায় কার? দায় আইন উপদেষ্টার কাঁধে বর্তাতে চান অনেকে।

বর্তমানে ২৬৬ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা অথবা সহিংসতা–সংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে মামলা চলছে এবং ১৩ সাংবাদিক গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দী আছেন উল্লেখ করে ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ‘তারা যদি অপরাধ করে থাকেন, তাহলে অবশ্যই তাদের বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু আজকে এতাদিন ধরে কারাগারে, তারা জামিন পাচ্ছেন না। তাদের কোনো আইনি প্রক্রিয়া চলছে না। বিচার হচ্ছে না। তাহলে এটা কী চলতে থাকবে!’

মাহফুজ আনাম বলেন, ‘কারো যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে বরং উপদেষ্টাদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টনের দিকে তাকালেই বর্তমান বিশৃঙ্খলার একটি চিত্র স্পষ্ট হয়। আমরা আইন এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ন্যস্ত করেছি এমন একজনের কাঁধে, এর ফলাফল, আমাদের দেশে সাংবাদিকরা হত্যা মামলার আসামি এবং আইনি ব্যবস্থা পরিণত হয়েছে নাগরিকদের হয়রানি, ভয় দেখানো ও অর্থ আদায়ের অস্ত্রে।’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমরা একই ব্যক্তির কাছে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং এর পাশাপাশি কৃষি মন্ত্রণালয় দিয়েছি। তার পক্ষে কি এটা সম্ভব? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অত্যন্ত জটিল এবং ২৪ ঘণ্টার দায়িত্ব নয় কি? কৃষির জন্য ভাবার সময় কখন তার? অথচ আমাদের বেঁচে থাকার তিনটি স্তম্ভ হলো—কৃষি, পোশাক খাত ও রেমিট্যান্স।'

সাংবাদিকরা এসব মামলায় পড়েছেন আর একটি কদম এগোয়নি মামলার তদন্তের ব্যাপারে উল্লেখ করে মাহফুজ আনাম বলেন, ‘আইন উপদেষ্টা বলছেন, আমাদের কিছু করার নেই, জনগণের অধিকার আছে মামলা করার। মেনে নিলাম মামলা করা অধিকার; কিন্তু কোনো আইনের যদি অপপ্রয়োগ হয়, তাহলে কী সরকার কিছু করবে না?’

ডেভিড বার্গম্যান মনে করেন, এ অবস্থানের ভার যদি শুধু আইন উপদেষ্টার কাঁধে ছেড়ে দেওয়া হয়, তবে তা সহজ হবে না; বরং এটি পুরো ইউনূস মন্ত্রিসভার একটি সম্মিলিত অবস্থান। এখানে যারা নিজেদের গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের পক্ষে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে দাবি করেন, তাদের সবারই স্পষ্ট ও প্রকাশ্যে এ বিষয়ে মুখ খুলতে হবে। তাদের বলতে হবে—বিচার প্রতিশোধ নয় এবং সাংবিধানিক গণতন্ত্রে বিচারবহির্ভূতভাবে আটক রাখার কোনো স্থান নেই।

ডেভিড বার্গম্যান বলেন, ‘গ্রেপ্তারের ঘটনার অনেকগুলোই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এফআইআরের মাধ্যমে শুরু হয়েছে। এগুলো হয়তো সরাসরি সরকারের নয়, বরং রাজনৈতিক দল বা অন্য রাজনৈতিক চরিত্রের সহায়তায় দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু এসব অপব্যবহারে হস্তক্ষেপ করে সেগুলো সংশোধন করতে সরকারের ব্যর্থতা অগ্রহণযোগ্য।’

তিনি বলেন, ‘সাংবাদিক দম্পতি ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদ ৮ মাস, লেখক ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাবেক নেতা শাহরিয়ার কবির ৮ মাস আর জ্যেষ্ঠ সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু ও শ্যামল দত্ত ৭ মাস ধরে কারাবন্দী। তাদের সবাইকে একটি নির্দিষ্ট গোলাগুলির ঘটনায় হত্যা বা হত্যাচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এ অভিযোগের পক্ষে তাদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে, এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি।’

সাংবাদিক ড. আসিফ নজরুল মাহফুজ আনাম ডেভিড বার্গম্যান

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন