সিরিয়ার টেলিভিশন সিরিজ তাওয়াক আল-বানাতের একটি দৃশ্য ধারণের মুহূর্ত। ছবি: এএফপি
বিশ্বে টেলিভিশন সিরিজ রপ্তানিতে তুরস্কের অবস্থান এখন তৃতীয়, তাদের সামনে শুধু আমেরিকা ও ব্রিটেন। ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তুরস্কের টিভি সিরিজের বৈশ্বিক চাহিদা বেড়েছে ৮৪ শতাংশ। একই সময়ে কোরীয় নাটকের চাহিদা বেড়েছে ৭৩ শতাংশ। তথ্য বিশ্লেষণকারী সংস্থা প্যারট অ্যনালাইটিক্সের সূত্রে এ খবর জানায় দ্য ইকোনমিস্ট।
তুরস্কের টিভি সিরিজগুলো এখন শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বরং ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকাতেও জনপ্রিয়। প্যারট অ্যনালাইটিক্সের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, যে দেশগুলো তুরস্কের টিভি সিরিজ সবচেয়ে বেশি আমদানি করেছে, সেগুলো হলো স্পেন, সৌদি আরব ও মিসর। ইস্তাম্বুল চেম্বার অব কমার্সের প্রাথমিক হিসাব, ২০২২ সালে টিভি সিরিজ রপ্তানি করে ৬০ কোটি ডলার আয় হয়েছে। অনেক বিশ্লেষক বলেছেন, শিগগিরই এ অঙ্ক বিলিয়ন বা শতকোটি ডলার স্পর্শ করবে।
দ্য ইকোনমিস্টের এক সংবাদে বলা হয়েছে, সুলতান সুলেমান টিভি সিরিজের মধ্য দিয়ে তুরস্কের টিভি সিরিজ বৈশ্বিক পরিসরে জায়গা পেতে শুরু করে। এরপর থেকে সারা বিশ্বে তুরস্কের টিভি সিরিজের কদর বাড়তে থাকে। এ তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয় ‘গাদ্দার’ (ক্ষমাহীন)। এটি এক যুদ্ধফেরত সৈনিকের জীবনকাহিনি, যে নিজের পরিবারকে বাঁচাতে হন্তারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে বাধ্য হয়।
তুরস্কের মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সিরিয়ার একসময়ের নাটকগুলো মূলত ঐতিহাসিক বা সামাজিক প্রেক্ষাপটের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হতো এবং আরবে বসবাসকারী মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটাতো, যা দর্শকদের আকৃষ্ট করত। রমজান মাসে সিরিয়ান ড্রামা একসময় মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তুমুল জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে অর্থ ও আন্তর্জাতিক সংযোগের ঘাটতির ফলে সেই গৌরব ধূসর হয়ে যায়। তবে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে নিষেধাজ্ঞা, রাজনৈতিক নিঃসঙ্গতা ও অর্থনৈতিক অচলাবস্থার মধ্য দিয়ে চলা সিরিয়ার টেলিভিশন ও বিনোদনশিল্পে অবশেষে আশার আলো দেখা দিয়েছে।
আজ সোমবার (৭ই জুলাই) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, নাটক ও বিনোদনশিল্পের অচলাবস্থা ভাঙতে সিরিয়ার নতুন সরকার কাতারভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আল মাহা ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে একটি বড় চুক্তিতে পৌঁছেছে। এ চুক্তির অংশ হিসেবে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের এক প্রান্তে নির্মাণ হবে একটি আধুনিক মিডিয়া ও বিনোদন কমপ্লেক্স। ‘সিটি অব দামেস্ক গেট’ নামে প্রায় ২০ লাখ বর্গমিটারজুড়ে প্রকল্পটি দেশটির সিনেমা, টেলিভিশন ও পর্যটন খাতে নতুন প্রাণসঞ্চার করতে যাচ্ছে।
এ উদ্যোগের মাধ্যমে ৪ হাজারেরও বেশি স্থায়ী ও ৯ হাজার মৌসুমি চাকরি তৈরি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। পাশাপাশি এটি আরব বিশ্বের টেলিভিশন চ্যানেল ও নির্মাতাদের কাছে সিরিয়াকে একটি ব্যবসাবান্ধব ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ চিত্রায়ণ গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরবে।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে সিরিয়ার ওপর দীর্ঘদিন ধরে চলা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পরই এ চুক্তির অন্যতম প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। এর ফলে সিরিয়ার বিনোদনজগতে আন্তর্জাতিক আগ্রহ ফিরে এসেছে। এ ছাড়া পর্যটন, রিয়েল এস্টেট ও মিডিয়া খাতগুলোতেও এ ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
সিরিয়ার প্রবীণ নির্মাতা আহমদ আলশেইখ বলেন, ‘এটা নিছক কূটনৈতিক সংকেত নয়, বরং আমাদের টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রশিল্পের জন্য এক নতুন সূচনা।’ তার মতে, দশ বছর ধরে যেসব মৌলিক যন্ত্রপাতি, অংশীদারত্ব ও অর্থায়নের সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল সিরিয়া, এখন আবার সেগুলোর দরজা খুলছে।
এ পরিবর্তন শুধু অর্থনৈতিক নয়, মানসিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। আলশেইখ বলেন, ‘আইনি ও আর্থিক ভয় কেটে গেলে স্বাভাবিকভাবেই দরজা খুলে যায়। আমি আশা করি, শিগগির বিজ্ঞাপনদাতা, সম্প্রচার সংস্থা ও পরিবেশকরা ফিরবেন এবং প্রযোজনার মানও বাড়বে।’
তার মতে, সিরিয়ান নাটকের শক্ত ভিত হিসেবে আছে সংবেদনশীলতা ও সমাজমনস্ক গল্প। তাই এর পুনর্জন্ম সম্ভব। তবে এর জন্য চাই পেশাগত মান, আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব এবং নতুন বিনিয়োগের প্রতি আস্থা।
এ প্রেক্ষাপটে নেটফ্লিক্স ও শাহিদের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর দৃষ্টি সিরিয়ার দিকে পড়ছে বলেও মত দিয়েছেন আলশেইখ। তার বিশ্বাস, ২০২৬ সালের রমজান হবে সিরিয়ান ড্রামা পুনরুদ্ধারের মোক্ষম সময়।
এ আশা নিয়ে এগোচ্ছেন দেশটির তরুণ নির্মাতারাও। তাদের একজন পুরস্কারজয়ী পরিচালক আনাস জাওয়াহরি বলেন, ‘এক যুগ ধরে আমরা সৃজনশীল ও আর্থিকভাবে পঙ্গু ছিলাম। অবশেষে এখন আমরা সহযোগিতা করতে পারছি। সিরিয়া এখনো গল্প বলার জন্য উর্বর মাটি।’
জাওয়াহরির আলোচিত ডকুমেন্টারি ‘মাই মেমরি ইজ ফুল অব গোস্টস’ যুদ্ধপীড়িত হোমস শহরের মানুষের স্মৃতি ও যন্ত্রণাকে তুলে ধরে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়। এখন তিনি মনে করছেন, আরও সাহসী ও সত্যনিষ্ঠ গল্প বলার সময় এসেছে।
তার ভাষায়, ‘এখন আমাদের দরকার তহবিল, উৎসব ও প্ল্যাটফর্মে সহায়তা। আমরা মুখ বন্ধ করে অপেক্ষা করেছি। এখন আবার আমাদের কণ্ঠ তুলে ধরার সময় এসেছে।’
খবরটি শেয়ার করুন