সোমবার, ২৮শে জুলাই ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৩ই শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

তিন কারণে নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডেঙ্গু, কী পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের?

নিজস্ব প্রতিবেদক

🕒 প্রকাশ: ০২:০৯ অপরাহ্ন, ১৩ই আগস্ট ২০২৩

#

সূত্র : স্বাস্থ্য অধিদপ্তর- ছবি: সংগৃহীত

ডেঙ্গুর প্রকোপ এবার শুরু হয়েছিল বর্ষা শুরুর অনেক আগেই। তখন থেকেই বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ার করে আসছিলেন। কিন্তু ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি এড়ানো যায়নি।

আগস্ট মাসে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালে। প্রতিদিন গড়ে মৃত্যু হচ্ছে দশ জনের বেশি মানুষের। পরিস্থিতি কতটা নাজুক, তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীরের কথায় স্পষ্ট। তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগী কমছে না, সারাদেশেই বাড়ছে। রোগীর ভিড় সামাল দিতে বেগ পেতে হচ্ছে। আমরা আমাদের মতো র‌্যাশনালাইজ করে ম্যানেজ করছি। বিভিন্ন হাসপাতালে যাচ্ছি, বলছি যাদের প্রয়োজন আছে শুধু তাদরে ভর্তি নেওয়ার জন্য। যাদের ওয়ার্নিং সাইন নাই তারা টেলিমেডিসিন নেবে।

গত কয়েক বছর ধরে প্রতি বছরই কমবেশি ভোগাচ্ছে এডিস মশাবাহিত এই রোগ। প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতা এবং পূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সাফল্য পেলেও বাংলাদেশ পারছে না কেন?

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এক্ষেত্রে কয়েকটি কারণের কথা বলছেন। এর মধ্যে একটি হলো- বাংলাদেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা শুরু হয় প্রতি বছর মৌসুমের শুরুতে; দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত কোনো উদ্যোগ এখানে অনুপস্থিত।

দ্বিতীয়ত, কয়েক বছরে এই রোগটি ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়লেও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের বেশিরভাগ উদ্যোগ শহরকেন্দ্রিক।

আর তিন নম্বর কারণ হলো- সবাই একবাক্যে বলছেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে মানুষের মধ্যেও সচেতনতার অভাব রয়েছে।

আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, ভারতের কলকাতা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রেখেছে সারা বছর ধারাবাহিকভাবে কাজ করায়। বাংলাদেশে ডেঙ্গুকে মৌসুমি সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটা যে জনস্বাস্থ্যের জরুরি সমস্যা, সে চিন্তা থেকে কাজ হচ্ছে না।

এ বছর হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ইতোমধ্যে ৮২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমান ধারায় রোগী বাড়তে থাকলে ২০১৯ সালের এক লাখ রোগীর রেকর্ড এ মাসেই ভেঙে যওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে ৩৮৭ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এক বছরে এত মৃত্যু আর কখনও বাংলাদেশকে দেখতে হয়নি।

যারা আক্রান্ত হয়ে পরীক্ষা করান না, বা পরীক্ষা করালেও হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না, তাদের সংখ্যা এই হিসাবে আসেনি। ফলে আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

ডেঙ্গু সারাদেশে : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, গত ৫ জুন পর্যন্ত সারাদেশে ভর্তি রোগীর ২৮ দশমিক ০৯ শতাংশ ছিল ঢাকার বাইরের। সেই হার ৫ আাগস্টে বেড়ে হয়েছে ৪৬ দশমিক ০৩ শতাংশে। গত ৩১ জুলাই থেকে ৭ অগাস্ট পর্যন্ত প্রতিদিনই ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে রোগী ভর্তি হচ্ছে বেশি। অথচ ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু মোকাবেলার উদ্যোগ সামান্য। ঢাকা ও চট্টগ্রামের পর এ বছর সবচেয়ে বেশি রোগী বরিশাল বিভাগে। এ বিভাগে এ বছর ৭ হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন। রোববার পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ১০৫৮ জন রোগী এসেছেন পিরোজপুর জেলা থেকে।

কলকাতায় মশা নিয়ন্ত্রণ: পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় ৩১ জুলাই বিধানসভায় জানান, এ বছর পশ্চিমবঙ্গে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন সাড়ে চার হাজার জন। হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৯০০ জন রোগী। এ পর্যন্ত রাজ্যে আটজনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে। তাদের মধ্যে কলকাতায় ২৯০ জন রোগী শনাক্ত এবং একজনের মৃত্যু হয়েছে।

কলকাতায় মশা নিয়ন্ত্রণে তিনটি স্তরে কাজ করা হয়। প্রথমে প্রতিটি ওয়ার্ড পর্যায়ে, কয়েকটি ওয়ার্ড নিয়ে একটি ‘বারা’ এবং সবগুলো বারার কার্যক্রম তদারক করে মিউনিসিপ্যালিটি। নগর কর্তৃপক্ষের পাঁচজন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, যারা মশা নিয়ে নিয়মিত গবেষণা কার্যক্রম চালান। ৩২টি র‌্যাপিড অ্যাকশন টিম আছে, প্রতিটি টিমের জন্য একটি করে গাড়ি দেওয়া আছে। ডেঙ্গু শনাক্ত কেন্দ্র করা হয়েছে।

প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রক্ত পরীক্ষাসহ সব ধরনের পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ৩০০ জন চিকিৎসক কাজ করছেন। প্রতিদিন যত ডেঙ্গু পরীক্ষা হয়, তার রিপোর্ট নেওয়ার জন্য একজন লোক ঠিক করা আছে। কলকাতার ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ জানান, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গত ১২ বছরে একটি কাঠামো তৈরি করেছেন তারা। এখন সেভাবে কাজ চলছে।

“আমরা সারাবছরই কাজ করি। আমরা ধোয়া দিই না, মশাকে উৎসে নির্মূলে জোর দিয়েছি। এজন্য কলকাতা শহরে সাড়ে তিন হাজার প্রশিক্ষিত কর্মী আছে। তারা প্রতি সাতদিন অন্তর একটি এলাকায় যায়। তারা মশা দেখলেই চিনতে পারে। সে অনুযায়ী মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা তারা নেয়।”

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ডেঙ্গু রোগী এখন সারাদেশেই পাওয়া যাচ্ছে। এজন্য একটা আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ করা দরকার। যেখানে নানা ধরনের বিশ্লেষণ হবে, সে অনুযায়ী স্থানীয় পর্যায়ে নির্দেশনা যাবে। ২০০০ সাল থেকে প্রতি বছরই ডেঙ্গু হলেও তা ঠেকাতে কোনো দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এটা অনেকটা ডায়রিয়ার প্রকোপের মত। রোগী আসবে স্যালাইন তৈরি করে রাখ। ডেঙ্গুকেও এরকম মনে করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নগরবাসীর অংশগ্রহণ জরুরি। বেশিরভাগ এইডিস মশার লার্ভার উৎস বাড়িঘর, বহুতল ভবনের ভেতরে হলেও লোকজন দায় চাপাচ্ছে সিটি করপোরেশনের ওপর।

রাস্তাঘাটে ছিটানো ওষুধ কতটা কাজে আসছে সেই প্রশ্ন তুলে বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, লক্ষ্য অনুযায়ী মশার ওষুধ দেওয়া হলো কি না সেটা জরুরি। ওইটা ঠিকমত না হলে মশা নিধন হবে না। আর সিটি করপোরেশন বলে ঘরের ভেতরের মশা মারা তাদের কাজ নয়। কিন্তু সিঙ্গাপুরে কী করে? তারা বাড়ির ভেতর গিয়ে ওষুধ দিয়ে আসে।

আই. কে. জে/ 

ডেঙ্গু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন