ফাইল ছবি
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের মতে দেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দল হলো বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত, বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি তার ধর্তব্যের মধ্যে নেই। জামায়াত ও এনসিপির প্রধান একটি দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে তিনি বলেন, 'বিএনপির উচিত বিকল্প প্রস্তাবটির যৌক্তিকতা বিবেচনা করা।' তার মন্তব্যে স্ববিরোধিতাও আছে।
গণভোট আয়োজনসহ কয়েকটি ইস্যুতে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে মতবিরোধ মাঠে গড়িয়েছে। এক দল অবস্থান নিয়েছে আরেক দলের বিরুদ্ধে। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার মতপার্থক্য ও বিভক্তি রাজনীতিতে অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি সভায় রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনায় বসে সাতদিনের মধ্যে মতৈক্যে পৌঁছানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু সরকারের এই সিদ্ধান্তে অনিশ্চয়তা কতটা কাটবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। তবে 'তিনটি প্রধান দলের মধ্যে মতৈক্যের একটি যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে বলে আমরা দেখতে পাচ্ছি' বলে মন্তব্য করেন মাহফুজ আনাম। বিএনপিসহ সমমনা কয়েকটি দল সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেও মাহফুজ আনামের মতে, 'শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছে নির্বাচন আসছে দীর্ঘ ১৭ বছর পর এবং আশা করি, এটি অবাধ ও সুষ্ঠু হবে।'
কোন হিসাব বা পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে মাহফুজ আনাম জামায়াত ও এনসিপিকে প্রধান দলের তালিকায় ঠাঁই দিলেন, তা ব্যাখ্যা করেননি। চলতি বছরের ২৮শে ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জমায়েতের মধ্য দিয়ে এনসিপির আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে। এনসিপি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির যৌথ উদ্যোগে। এখনো পর্যন্ত স্থানীয় পর্যায়ের কোনো নির্বাচনের মাধ্যমেও দলটির জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক দক্ষতার প্রমাণের সুযোগ হয়নি।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, চলতি অর্থবছরে দেশীয় বেসরকারি বিনিয়োগ গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে এবং নির্বাচিত সরকার না থাকায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা ও আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। মাহফুজ আনামের দাবি, 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ও মর্যাদার কারণে বাংলাদেশের বৈশ্বিক সম্পর্ক নিঃসন্দেহে উন্নত হয়েছে। তবে, একটি নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত সেটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে না।'
মাহফুজ আনাম বলেন, 'আমরা যতটা বুঝতে পারছি, জামায়াত ও এনসিপির প্রধান দাবি জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। এটি একটি যৌক্তিক দাবি এবং এর মাধ্যমে উচ্চকক্ষের কার্যকারিতা বাড়বে বলে আমরা মনে করি। অন্তত দিন শেষে উচ্চকক্ষকে নিম্নকক্ষের রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত করা যাবে না। বিএনপির প্রস্তাব যদি গৃহীত হয়, সেটাই হবে। বিএনপির উচিত বিকল্প প্রস্তাবটির যৌক্তিকতা বিবেচনা করা।'
'লেসনস ফ্রম মামদানিস ম্যাজিক: পুট ভোটারস অ্যাট দ্য সেন্টার পলিটিক্স' শিরোনামে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক উপসম্পাদকীয়তে মাহফুজ আনাম এসব কথা বলেন। তার লেখা আজ শুক্রবার (৭ই নভেম্বর) পত্রিকাটির ছাপা সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে। লেখায় তিনি বিএনপির একটি দাবির প্রতিও সমর্থন জানান।
তিনি বলেন, 'জামায়াত ও এনসিপির উচিত বিএনপির প্রস্তাব মেনে নেওয়া—যাতে জোটের সদস্যেরা জোটের নেতৃত্বে থাকা দলের প্রতীক ব্যবহার করতে পারে। এটা হয়তো সর্বোত্তম সমাধান না, কিন্তু আপসের ভিত্তিতে ভিন্নমতাবলম্বী দলগুলোর এটি মেনে নেওয়া উচিত। 'জোট হলেও দলীয় প্রতীকে ভোট' নিয়ে ইতোমধ্যে গেজেট প্রকাশিত হলেও রাজনৈতিক ঐকমত্যে পৌঁছানো গেলে তা সংশোধনের জন্য পর্যাপ্ত সময় এখনো আছে।'
তার মতে, গণভোটের সময় নিয়ে বিএনপির প্রস্তাব, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে। যদিও আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি, জুলাই সনদের বিষয়বস্তু সম্পর্কে ভোটাররা খুব কম জানায় এমন গণভোট ন্যায্য হবে না। তারপরও নির্বাচন আয়োজনের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে এনসিপি ও জামায়াতের উচিত বিএনপির এই প্রস্তাব মেনে নেওয়া। আলাদা দিনে গণভোট আয়োজন মানে আরেকটি বিরাট আয়োজন এবং ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ। এর ব্যবস্থাপনাও কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে।
আবার গণভোট নিয়ে তিনি স্ববিরোধী কথাও বলেছেন। তার মতে, জুলাই সনদ চূড়ান্ত করতে আমরা কত অর্থ ও সময় ব্যয় করেছি। অথচ সাধারণ মানুষকে এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবহিত করতে কতটুকু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? কৃষক, দিনমজুর, রিকশাচালক, ফেরিওয়ালা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, শ্রমিক, গৃহকর্মী—যাদের সংখ্যা কয়েক কোটি—তাদের খুব অল্প সংখ্যকই জানেন জুলাই সনদে কী আছে। গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল একটি সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত নথি নিয়ে সেই বিষয়ে গণভোট আয়োজন করা কি নৈতিক ও নীতিগতভাবে ঠিক হবে? এমন একটি গণভোট কি জনগণের প্রকৃত মতামতের প্রতিফলন ঘটাবে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, জুলাই সনদ ও গণভোট প্রশ্নে ঐকমত্যে পৌঁছানো ও নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব যেমন অন্তর্বর্তী সরকারের, সেই দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোরও। এখানে দায়িত্বকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। ঐকমত্য কমিশন সুপারিশ দিয়ে দেওয়ার পর এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মূল দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের।
তবে আজকের উপসম্পাদকীয়ের আলোচনায় মাহফুজ আনাম সরকারের দায়িত্বের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে নানা শ্রেণি-পেশার নেটিজেনদের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
খবরটি শেয়ার করুন