হুমায়ুন ফরীদি। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অভিনয়-জগতের উজ্জ্বলতম শিল্পী ছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। তার সময়ে নিজস্ব অভিনয়ের জৌলুসে ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। একাধারে মঞ্চ, টিভি নাটক ও চলচ্চিত্র অঙ্গনের দর্শক-হৃদয় ছুঁয়ে থাকা এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম হুমায়ুন ফরীদি । আজ সোমবার (২৯ মে) এই কিংবদন্তী অভিনেতার ৭১তম জন্মদিন।
মঞ্চ থেকে চলচ্চিত্র অভিনয়ের সবখানে তিনি রাজত্ব করেছেন দুর্দান্ত প্রতাপে। কয়েক দশক অভিনয়ে তিনি মাতিয়ে রেখেছিলেন নিজের অভিনয় দিয়ে। ‘ভাঙ্গনের শব্দ শুনি’র সেরাজ তালুকদার, ‘সংশপ্তক’এর কানকাটা রমজান কিংবা ‘শ্যামল ছায়া’র একজন মুক্তিযোদ্ধাকে মানুষ মনে রাখবে অনেকদিন। নিজেকে কিংবদন্তিতে পরিণত করেছেন, তিনি হুমায়ুন ফরীদি।
১৯৫২ সালের ২৯ মে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার তুমুলিয়া ইউনিয়নের চুয়ারিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ুন ফরীদি। তার বাবার নাম এ টি এম নূরুল ইসলাম ও মা বেগম ফরিদা ইসলাম। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়।
১৯৬৫ সালে পিতার চাকরির সুবাদে মাদারীপুরের ইউনাইটেড ইসলামিয়া সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ফরীদি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন নাট্যাঙ্গনের সঙ্গে। তাই অর্থনীতিতে এতো ভালো ফলাফল করেও পেশা হিসেবে বেছে নেন অভিনয়কে।
এরপর মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র, তিন মাধ্যমেই দাপিয়ে বেড়ান এই গুণী অভিনেতা। তিন দশকের বর্ণিল ক্যারিয়ারে তিনি উপহার দিয়েছেন অনেক জনপ্রিয় নাটক ও চলচ্চিত্র।
হুমায়ুন ফরিদীর অভিনয়ে হাতেখড়ি অবশ্য মাত্র ১২ বছর বয়সে। কিশোরগঞ্জের মহল্লার নাটক ‘এক কন্যার জনক’-এ প্রথম অভিনয়ে করেন তিনি। স্কুল জীবনেই নাটকের নির্দেশনা দেওয়া অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তিনি। ‘ভূত’ নামে নাটকের নির্দেশনা দেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে নাট্যজন সেলিম আল দীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে হুমায়ুন ফরিদীর।
১৯৭৬ সালে নাট্যজন সেলিম আল দীন-এর উদ্যোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় নাট্যোৎসব। আর হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন এর অন্যতম প্রধান সংগঠক। আর এই উৎসবে ফরীদির নিজের রচনায় এবং নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় ‘আত্মস্থ ও হিরন্ময়ীদের বৃত্তান্ত’ নামে একটি নাটক। ওই সময় নাটকটি সেরা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
এরপর ঢাকা থিয়েটারে ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’, ‘ফণীমনসা’, ‘শকুন্তলা’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘কেরামত মঙ্গল’ নাটকগুলোতে অভিনয় করে ভূয়সী প্রশংসিত হন হুমায়ুন ফরিদী। নাট্টজগতে অদ্বিতীয় ব্যক্তি হয়ে ওঠেন।
হুমায়ুন ফরিদী টিভি পর্দায় প্রথম অভিনয় করেন আতিকুল ইসলাম চৌধুরীর ‘নিখোঁজ সংবাদ’ নাটক দিয়ে। তবে ১৯৮৩ সালে সেলিম আল দীনের রচনায় ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’ নাটকে সেরাজ তালুকদারের চরিত্রে অভিনয় করে দেশব্যাপী জনপ্রিয়তা পান ফরিদী।
এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি ফরিদীকে। ‘সাত আসমানের সিঁড়ি’, ‘একদিন হঠাৎ’, ‘চাঁনমিয়ার নেগেটিভ পজেটিভ’, ‘অযাত্রা’, ‘পাথর সময়’, ‘দুই ভাই’, ‘শীতের পাখি’, ‘সংশপ্তক’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘নীল আকাশের সন্ধানে’, ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’, ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’, ‘বকুলপুর কতদূর’, ‘মহুয়ার মন’, ‘সমুদ্রে গাঙচিল’, ‘তিনি একজন’, ‘চন্দ্রগ্রস্ত’, ‘কাছের মানুষ’, ‘মোহনা’, ‘বিষকাঁটা’, ‘শৃঙ্খল’, ‘ভবের হাট’ এসব নাটকের তার অভিনয় তাকে কিংবদন্তি করে তুলেছে।
আশির দশকে তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’ সিনেমার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে পা রাখেন তিনি। পরবর্তীতে বাংলা সিনেমার জগতে নিজেই এক অধ্যায় হয়ে উঠেছেন হুমায়ুন ফরীদি। একে একে উপহার দিয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় চলচ্চিত্র।
‘মাতৃত্ব’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন হুমায়ুন ফরীদি। পরে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করেন।
আরো পড়ুন:ফেসবুকে বিশেষ বার্তা দিলেন শাকিব
হুমায়ুন ফরীদির অন্যতম জনপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলো হচ্ছে ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘ভণ্ড’, ‘ঘাতক’, ‘ব্যাচেলর’, ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘টাকার অহংকার’, ‘অধিকার চাই’, ‘সন্ত্রাস’, ‘দহন’, ‘লড়াকু’, ‘দিনমজুর’, ‘বীর পুরুষ’, ‘বিশ্ব প্রেমিক’, ‘আজকের হিটলার’, ‘দুর্জয়’, ‘শাসন’-সহ অসংখ্য সিনেমা।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন হুমায়ুন ফরীদি। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৬০ বছর।
এম/