ছবি: সংগৃহীত
সাধারণভাবে আমরা মনে করি, সন্তানের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য বড় ভূমিকা পালন করেন মা। গর্ভাবস্থা থেকে শুরু করে জন্মের পরের বছরগুলোতে মায়ের যত্ন, ভালোবাসা ও মানসিক অবস্থা শিশুর ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। এটা বহু গবেষণায় প্রমাণিত। খবর সিএনএনের।
কিন্তু সাম্প্রতিক একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা জানাচ্ছে, শুধু মা নন, বাবার মানসিক স্বাস্থ্যও সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অস্ট্রেলিয়ার ডিকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে শিশুস্বাস্থ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষণা সাময়িকী ‘জেএএমএ পেডিয়াট্রিকস’-এ।
গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থা থেকে সন্তানের বয়স দুই বছর পর্যন্ত সময়, যা চিকিৎসা পরিভাষায় পেরিনাটাল সময়কাল নামে পরিচিত; সেই সময় বাবার মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা বিষণ্নতার মতো সমস্যাগুলো শিশুর বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
গবেষণার পরিধি ও গুরুত্ব
এ গবেষণা মোট ৮৪টি আন্তর্জাতিক গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে তৈরি হয়। এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল হাজারো বাবা ও সন্তানের জুটি। গবেষকরা দেখেছেন, বাবার মানসিক অস্থিরতা; যেমন উদ্বেগ, বিষণ্নতা বা অতিরিক্ত মানসিক চাপ, সন্তানের ভাষা শেখা, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ, সামাজিক আচরণ এমনকি শারীরিক বৃদ্ধিতে পর্যন্ত প্রভাব ফেলতে পারে। যদিও প্রভাব খুব বড় নয়, কিন্তু এটি স্পষ্ট ও ধারাবাহিকভাবে উপস্থিত; বিশেষ করে শিশু জন্মের পরবর্তী সময়, অর্থাৎ শিশুর শৈশবকালে এই প্রভাব বেশি দেখা যায়।
শিশুর কোন কোন দিক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে
গবেষণায় শিশুদের ছয়টি প্রধান বিকাশের ক্ষেত্র বিশ্লেষণ করা হয়। সেগুলো হলো—
সামাজিক ও আবেগগত বিকাশ: শিশুর আত্মনিয়ন্ত্রণ, বন্ধুত্ব গড়ে তোলা, সহানুভূতিশীল আচরণ।
ভাষাগত বিকাশ: কথা বলা ও বোঝার ক্ষমতা।
বুদ্ধিবৃত্তিক বা মানসিক বিকাশ: মনোযোগ, স্মৃতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও শেখার ক্ষমতা।
শারীরিক বৃদ্ধি ও সুস্থতা: উচ্চতা, ওজন, ঘুমের গুণমান ও হজম সমস্যা।
দক্ষতা: ছোট-বড় পেশি ব্যবহার করে কাজ করার ক্ষমতা; যেমন হাঁটাহাঁটি, হাত নাড়ানো বা জামার বোতাম লাগানো।
দৈনন্দিন কাজের ক্ষমতা: পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলা এবং দৈনন্দিন কাজ সামাল দেওয়া।
গবেষণায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে ভাষা, মানসিক ও সামাজিক বিকাশে।
কেন বাবার মানসিক স্বাস্থ্য এত গুরুত্বপূর্ণ
গবেষণার প্রধান লেখক ও ক্লিনিক্যাল মনোবিজ্ঞানী ড. ডেলিস হাচিনসন সিএনএনকে বলেন, ‘পিতৃত্বে প্রবেশ করাও বিশাল এক পরিবর্তন। অনেক পুরুষ এ সময় বিষণ্নতা, উদ্বেগ বা মানসিক চাপে ভোগেন। এটি তাদের সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক গঠনের ক্ষমতায় প্রভাব ফেলে।’
তার মতে, যদি কোনো বাবা মানসিকভাবে ভালো না থাকেন, তাহলে সন্তানের সঙ্গে সহজভাবে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলা তার পক্ষে কষ্টকর। এতে শিশুর নিরাপত্তা ও আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
এমনকি শিশু যদি বুঝতে না-ও পারে যে তার বাবা মানসিকভাবে ভালো নেই, তবু বাবার আচরণ ও প্রতিক্রিয়া শিশুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি শিশুর ব্যক্তিত্ব ও মনোভাব গঠনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।
কী করা উচিত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গর্ভাবস্থা ও সন্তানের জন্মের পর মা-বাবা উভয়ের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো উচিত। শুধু মা বিষণ্নতায় ভুগবেন, এমন নয়। বাবাও মানসিক চাপ বা হতাশায় ভুগতে পারেন।
সচেতনতা বাড়ানো, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় মানসিক স্বাস্থ্য মূল্যায়ন অন্তর্ভুক্ত করা, কাউন্সেলিং সেবা চালু রাখা এবং মা-বাবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করাই এখন জরুরি বলে মনে করছেন গবেষকরা।
মা-বাবা দুজনই সন্তানের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। সন্তান যেন ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে, সে জন্য মা-বাবার মানসিকভাবে সুস্থ থাকা অত্যন্ত জরুরি।
এ গবেষণা বলছে, শুধু মায়ের নয়, বাবার মনের কথাও শোনা উচিত। সন্তানের হাসিমুখের পেছনে মা-বাবার মনের শান্তি, ভারসাম্য ও ভালো থাকা সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি।
জে.এস/
খবরটি শেয়ার করুন