ছবি: সংগৃহীত
মুনওয়ার আলম নির্ঝর
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি শুধু নির্বাচন বা রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নে সীমাবদ্ধ নয়, এটি বহুমাত্রিক গভীর সংকট। যার মূলে রয়েছে গণতান্ত্রিক চর্চার দুর্বলতা ও সাধারণ মানুষের রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি আস্থার পতন। গত ৫ই আগস্টের পর শেখ হাসিনার দেশত্যাগ এবং ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ, এরপর সংস্কার ও নির্বাচন, এ দুইপক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব- এসব কিছু মিলিয়ে দেশের রাজনীতি যেন ঘূর্ণাবর্তে পড়ে গেছে।
দেশের বর্তমান যে বাস্তবতাকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব, সেটি হলো- 'ডেমোক্রেটিক ব্যাকস্লাইডিং' বা 'গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ তত্ত্ব'। এ তত্ত্ব অনুযায়ী, একটি দেশ সরাসরি স্বৈরতন্ত্রের অধীনে না গেলেও ধাপে ধাপে সেখানে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিগুলো যেমন, স্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থা, মুক্ত সংবাদমাধ্যম, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন একে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্য রূপ বলা যায়। অর্থাৎ, বাইরের কাঠামো ঠিক থাকলেও ভেতরের আত্মা হারিয়ে যায়।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। ধরুন, বাংলাদেশে গত কয়েক বছর নিয়মিত নির্বাচন আয়োজন হয়েছে, তবে সেই নির্বাচন পরিচালনায় স্বাধীনতা ছিল না, প্রতিদ্বন্দ্বীদের বাধা দেওয়া হয়েছে, ফলাফল নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন ছিল, ফলে সেই নির্বাচন প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র চর্চার অংশ ছিল না। একইভাবে, যদি কোনো দেশের সংবাদমাধ্যম সরকার বা শাসকদের বিরুদ্ধে সত্য প্রকাশ করতে না পারে, কিংবা নাগরিকরা ভয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করতে না পারেন, তবে সেখানেও গণতন্ত্রের অস্তিত্ব শুধু একধরনের আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় এসব লক্ষণ স্পষ্টভাবে বিদ্যমান। বহু বছর ধরে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের অংশগ্রহণকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধু ক্ষমতার পালাবদলের খেলায় মেতে থেকেছে। দলীয় স্বার্থে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবহার, বিরোধীদের দমন, গুম ও মিথ্যা মামলার রাজনীতি এবং সবচেয়ে উদ্বেগজনকভাবে, ভোটাধিকার খর্ব করা- এসব মিলিয়ে মানুষের মননে গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে একটি ধারণা: 'রাজনীতি মানে প্রতারণা'।
এ বিশ্বাসহীনতা সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে তরুণদের মধ্যে। যারা দেশের ভবিষ্যৎ, সেই তরুণদের বড় একটি অংশ রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তারা ভাবছে, কোনো পক্ষই সত্যিকার অর্থে জনগণের কথা ভাবে না। অনেকে ভাবছে, রাজনীতিতে জড়ানো মানে হয় বন্দী হওয়া, না হয় নির্বাসিত হওয়া। কেউ কেউ দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবছে, কেউবা নীরব থেকে বাঁচতে চাইছে। এ নীরবতা ভয়ানক। কারণ, গণতন্ত্র টিকে থাকে মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর, গুটিয়ে থাকা ভীত মানুষের ওপর নয়।
অন্যদিকে যাদের দায়িত্ব ছিল সমাজকে আলোকিত করা—সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, তাদের অনেকেই আজ নিশ্চুপ, কেউ কেউ আবার নির্লজ্জভাবে ক্ষমতাবানদের প্রশংসা করে যাচ্ছেন। গণমাধ্যমের বড় অংশ এখন ব্যবসায়িক স্বার্থে বা রাজনৈতিক চাপে স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছে না। ফলে মানুষ সত্য জানতে পারছে না। যখন সমাজে সত্য চাপা পড়ে, তখন গুজব, ষড়যন্ত্র ও ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়, যা গণতন্ত্রের পরিপন্থী।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বললেও, জনগণের বড় একটি অংশ এতে আস্থা রাখতে পারছে না। কারণ, অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, যে কোনো সরকারই ক্ষমতায় গেলে প্রথমে বলে 'সংস্কার', পরে তা রূপ নেয় ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে। অন্যদিকে, নির্বাচন চাওয়া দলগুলোও অতীতে ক্ষমতায় গিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বদলে দলীয়করণ করেছে। ফলে সাধারণ মানুষের মনে বিশ্বাস জন্মেছে যে, এ দুই পথই ক্ষমতার জন্য, জনগণের জন্য নয়।
এ বিশ্বাসহীনতা থেকেই তৈরি হচ্ছে গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ বা ডেমোক্রেটিক ব্যাকস্লাইডিং। মানুষ রাজনীতিতে বিশ্বাস না করলে, সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনার প্রবণতা কমে যায়। তখন রাষ্ট্রে দুর্নীতি বাড়ে, কর্তৃত্ববাদের উত্থান ঘটে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে কিছু মানুষ প্রতিবাদ করতে চায়, কিন্তু ভয়, অনিশ্চয়তা আর দমননীতির কারণে তা সম্ভব হয় না।
এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন সাহসী ও বিবেকবান নেতৃত্ব এবং সচেতন নাগরিক সমাজ। মানুষের মধ্যে আবারও বিশ্বাস জন্মাতে হবে যে, রাষ্ট্র তাদের, রাজনীতি তাদের এবং ভবিষ্যৎও তাদের হাতেই। আর এ বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে কাজের মাধ্যমে, কথার মাধ্যমে নয়।
আমরা যদি গণতন্ত্রকে শুধু একটা নির্বাচন বা একটি পদের দখল হিসেবে দেখি, তাহলে ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য অন্ধকার। গণতন্ত্র একটি ধারাবাহিক অনুশীলন, যেখানে মতপার্থক্য থাকবে, বিতর্ক থাকবে, থাকবে অংশগ্রহণ ও সহনশীলতা। বাংলাদেশ এ চর্চা হারাতে বসেছে। এখনই যদি আমরা সচেতন না হই, তবে গণতন্ত্র শুধু অতীতের একটি অধ্যায় হয়ে থাকবে।
গণতন্ত্র কখনো নিখুঁত হয় না, কিন্তু এর বিকল্প আরও ভয়াবহ। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা এখন চরম সংকটে এ কথা স্বীকার না করলে আমরা শুধু আত্মপ্রবঞ্চনায় ভুগব। যখন নাগরিকরা রাষ্ট্রে আস্থা রাখে না, তখন রাষ্ট্রও আর নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে পারে না।
মুনওয়ার আলম নির্ঝর: সেন্টার অফ মিডিয়া এন্ড ইনফরমেশন ওয়ারফেয়ার স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মারা, মালয়েশিয়া।
এইচ.এস/
খবরটি শেয়ার করুন