ছবি: সংগৃহীত
২৩শে জুন ইতিহাসে পলাশী দিবস হিসেবে পরিচিত। এদিন বাংলার ইতিহাসের কালো দিন। ১৭৫৭ সালের এ দিনে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। প্রহসনের যুদ্ধে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ঘটে। সোনার বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করার ইতিহাস রচিত হয়।
নানা আলীবর্দী খার মৃত্যুর পর ১৭৫৬ সালের ১০ই এপ্রিল সিরাজউদ্দৌলা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে আসীন হন। তখন তার বয়স মাত্র ২২ বছর। তরুণ নবাবের সাথে ইংরেজদের বিভিন্ন কারণে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এছাড়া রাজ সিংহাসনের জন্য লালায়িত ছিলেন সিরাজের পিতামহ আলীবর্দী খার বিশ্বস্ত অনুচর মীর জাফর ও খালা ঘষেটি বেগম।
১৭৫৭ সালের ১২ই জুন কলকাতার ইংরেজ সৈন্যরা চন্দননগরের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। সেখানে দুর্গ রক্ষার জন্য অল্প কিছু সৈন্য রেখে তারা ১৩ই জুন অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করে। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পথে হুগলি, কাটোয়ার দুর্গ, অগ্রদ্বীপ ও পলাশীতে নবাবের সৈন্য থাকা সত্ত্বেও তারা কেউ ইংরেজদের পথ রোধ করে না। নবাব বুঝতে পেরেছিলেন, সেনাপতিরাও এ ষড়যন্ত্রে শামিল। কিন্তু ততক্ষণে তার আর করার কিছু ছিল না।
ইংরেজদের সাথে তারা যোগাযোগ স্থাপন কার্যকর করে নবাবের বিরুদ্ধে নীলনকশা পাকাপোক্ত করে। দিন যতই গড়াচ্ছিল, এ ভূখণ্ডের আকাশে ততোই কালো মেঘ ঘনীভূত হচ্ছিল। ১৭৫৭ সালের ২৩শে এপ্রিল কলকাতা পরিষদ নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করার পক্ষে প্রস্তাব পাস করে। এ প্রস্তাব কার্যকর করতে ইংরেজ সেনাপতি লর্ড ক্লাইভ রাজদরবারের অভিজাত সদস্য উর্মি চাঁদকে এজেন্ট নিযুক্ত করেন।
এ ষড়যন্ত্রের নেপথ্য নায়ক মীরজাফর, তা আঁচ করতে পেরে নবাব তাকে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করে আব্দুল হাদিকে অভিষিক্ত করেন। কিন্তু কূটচালে পারদর্শী মীর জাফর নবাবকে বশ করে আবারও প্রধান সেনাপতি পদে পুনর্বহাল হন। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, এ ভুল সিদ্ধান্তই নবাব সিরাজউদ্দৌলার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
মীর জাফর বিশ্বাসঘাতকতা করে তার সৈন্যবাহিনীকে শিবিরে ফেরার নির্দেশ দেন। এ সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা নবাবকে আক্রমণ করে। যুদ্ধ বিকেল পাঁচটায় শেষ হয় এবং নবাবের ছাউনি ইংরেজদের অধিকারে চলে আসে। ইংরেজদের পক্ষে সাতজন ইউরোপিয়ান এবং ১৬ জন দেশীয় সৈন্য নিহত হয়।
তখন কোনো উপায় না দেখে নবাব সিরাজউদ্দৌলা রাজধানী রক্ষা করার জন্য দুই হাজার সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু রাজধানী রক্ষা করার জন্যেও কেউ তাকে সাহায্য করেনি। ২৩শে জুন নবাব সিরাজউদ্দৌলা পতন ঘটে।বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়।
১৭৫৭ সালের ৩রা জুলাই আত্মগোপনে থাকা নবাব সিরাজউদ্দৌলা মহানন্দা নদীর পাড় থেকে বন্দি করে রাজধানী মুর্শিদাবাদে পাঠিয়ে দেয়। বন্দী হবার সময় নবাবের সাথে ছিলেন তার স্ত্রী লুতফা বেগম এবং চার বছর বয়সী কন্যা উম্মে জহুরা।
এর পরের দিন ৪ঠা জুলাই (মতান্তরে ৩রা জুলাই) মীর জাফরের আদেশে তার পুত্র মিরনের তত্ত্বাবধানে আরেক বিশ্বাসঘাতক মোহাম্মদী বেগ সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করে। মুর্শিদাবাদের খোশবাগে নবাব আলিবর্দী খানের কবরের কাছে তাকে কবর দেওয়া হয়।
পলাশী যুদ্ধে বাংলা পরাজিত হওয়ার মূল কারণ বিশ্বাসঘাতকতা। ২৩শে জুন বাংলার ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায় রচিত হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নবাব সিরাজদৌল্লার সাথে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, তারা প্রকারান্তরে দেশের সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।
ইতিহাস তাদের কাউকেই ক্ষমা করেনি, চক্রান্তকারীদের ভোগ করতে হয়েছে মর্মান্তিক পরিণতি। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত ‘মীরজাফর’ শব্দটি গালি।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় বেদনাদায়ক হলেও তিনি বাঙালির কাছে মহাবীর হয়ে আছেন। নবাবকে আজও বাঙালি জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। সেদিন যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, তাদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করে। এটাই ইতিহাসের নির্মম বাস্তবতা।
খবরটি শেয়ার করুন