ছবি: সংগৃহীত
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হতে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের কাছে 'তদ্বির' করেছেন অন্তত পাঁচ থেকে ছয় সাংবাদিক। এ তালিকায় আছেন টিভি চ্যানেলের টকশোর অতিথিও। উপদেষ্টা হতে না পেরে তারা এখন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের উপদেষ্টাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমন তথ্য আইন উপদেষ্টা নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে এক পোস্টে জানানোর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে, তারা কারা? কারো নাম উল্লেখ না করে আইন উপদেষ্টার করা এ অভিযোগ ‘বায়বীয়’ কী না, এমন প্রশ্নও কোনো কোনো নেটিজেনের।
ওই পোস্টের মাধ্যমে আসিফ নজরুল ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের লেখা এক কলামের 'জবাব' দিয়েছেন কী না, এমন প্রশ্নও কেউ কেউ তুলেছেন। মাহফুজ আনাম এক কলামে আইন উপদেষ্টাসহ কয়েক উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার কয়েক বিশেষ সহকারীকে কী প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, এ প্রশ্ন সামনে আনেন। ওই কলামে তিনি আসিফ নজরুলের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, সরকারের 'অনেককে বিদেশ থেকে নিয়ে আসা হচ্ছে এবং কোনো ধরনের জনপর্যালোচনা ছাড়াই আমাদের ওপর তাদের চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।'
ডেইলি স্টারের সাংবাদিকদের অভিযোগ, মাহফুজ আনামের সমালোচনার জের ধরে আইন উপদেষ্টা ইতিমধ্যে পত্রিকাটির বিরুদ্ধে অসত্য তথ্য দিয়ে 'মব সন্ত্রাসকে উস্কে' দেওয়ার চেষ্টা করেন। উপদেষ্টার ফেসবুক পোস্টের বক্তব্য তা-ই ডেইলি স্টারের সম্পাদক সম্পর্কে কী না, এ প্রশ্ন নেটিজেনদের। আইনের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি তিনি কেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিজের কাছে রেখেছেন, এ প্রশ্ন মাহফুজ আনামের। ডেইলি স্টারের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক সাংবাদিক সুখবর ডটকমকে বলেন, পত্রিকাটি সম্পর্কে আইন উপদেষ্টা ইতিমধ্যে 'উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত মন্তব্য' করেন।
বর্তমান সরকারের আমলে দেশের ২৬৬ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের 'রেকর্ড' এবং কারাবন্দী ১৩ সাংবাদিকের মাসের পর মাস জামিন না হওয়ায় আইন উপদেষ্টার দায় নিয়ে সমালোচনা করেন মাহফুজ আনাম। তবে তিনি কোনোভাবেই অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হতে তদ্বির করেননি। এ বিষয়ে তার কোনো আগ্রহও নেই। দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর কাছে উপদেষ্টা হওয়ার প্রস্তাব সরকার পাঠালেও তিনি তা ফিরিয়ে দেন। অন্যদিকে নেটিজেনদের বিভিন্ন বিষয়ে মতামতকে এখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোও গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সুখবর ডটকম আইন উপদেষ্টার ফেসবুক পোস্ট ঘিরে মন্তব্যগুলো পর্যালোচনা করেছে।
সামাজিক মাধ্যমে অনেক সাংবাদিক ও রাজনীতিমনস্ক নেটিজেন আইন উপদেষ্টার পোস্ট কেন্দ্র করে এমনও বলছেন, গত কয়েক বছরের মতো সাংবাদিকদের মধ্যে এতো ক্ষমতার ক্ষুধা আগে দেখা যায়নি। উপদেষ্টা পরিষদ বা মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, প্রধানমন্ত্রী-প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব, প্রেস উয়িংয়ের সদস্য, বিশেষ সহকারী এবং বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে প্রেস মিনিস্টার হওয়া এখন অনেকের লক্ষ্য। সাংবাদিকতা আসলে তাদের কাছে একধরনের উপলক্ষ মাত্র। একে ব্যবহার করে তারা টাকা কামানো, সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও লুটপাটের ক্ষেত্রগুলোতে পৌঁছান। গত বছরের অভ্যুত্থানের পর যতো সাংবাদিককে সরকারি ও রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হতে দেখা গেছে, তা সরকারের মেয়াদের তুলনায় 'রেকর্ড'।
সাংবাদিক, নেটিজেনদের দাবি, গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অন্যান্য খাতের মতো সাংবাদিকতায়ও যে সংস্কার ও পরিবর্তন আশা করা হয়েছিল, তা নিরাশায় পরিণত হয়েছে। এ খাতে সংস্কারের লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না। ৫ই আগস্টের পর চর দখলের মতো সংবাদমাধ্যমের শীর্ষপদগুলো দখলের প্রতিযোগিতা চলে। এর মধ্যে এমন অযোগ্য সাংবাদিকও রয়েছেন, যারা শীর্ষপদে বসে করে গত এক বছরেও পেশাগত যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারেননি। শুধু তা-ই নয়, ইতিমধ্যে তারা নিজে নানাভাবে বিতর্কিত হয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকারকেও বিতর্কের মধ্যে টেনে নিয়েছেন। আইন উপদেষ্টার বলা 'উপদেষ্টা হতে তদ্বির করা ওই পাঁচ-ছয়জন সাংবাদিক' তাদেরই সমচিন্তার কেউ কেউ হতে পারেন।
আসিফ নজরুল গত শুক্রবার (৪ঠা জুলাই) গভীর রাতে ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘গত বছর উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেকে আমার সাথে যোগাযোগ করেন। ৫-৬ জন যোগাযোগ করেন উপদেষ্টা হওয়ার জন্য। তাদের অধিকাংশই সাংবাদিক বা টকশোর আলোচক হিসেবে পরিচিত। আমি তাদের বিনয়ের সাথে বলি, ইউনূস (প্রধান উপদেষ্টা) স্যার খুব প্রয়োজন না হলে নতুন কাউকে নিতে চান না এবং সেটাও কেবল ছাত্র উপদেষ্টারা রাজি হলে সম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘এরপর চারজন খুব দক্ষ ও অভিজ্ঞ পেশাজীবীকে (যেমন- ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ স্যার বা ফয়জুল ভাই) নতুন উপদেষ্টা করা হয়। পরে আরো তিনজন অত্যন্ত করিৎকর্মা মানুষকে (আবরার ভাই, আকিজ বশির ভাই ও ফারুকী) অন্তর্ভূক্ত করা হয়। স্যার সিদ্ধান্ত নেন যে, কোনো অবস্থাতেই আর নতুন কাউকে নিয়োগ করা হবে না। যাই হোক, উপদেষ্টা হতে আগ্রহীদের কেউ কেউ মন খারাপ করেন। ফেসবুকেও নানা সময় প্রশ্ন তোলা হয়, উপদেষ্টারা নিয়োগ পেয়েছে কিসের যোগ্যতায়, জুলাই গণঅভ্যূত্থানে তারা কোথায় ছিল?’
তিনি বলেন, "আমি জানি, এটা সম্ভবত আমাকে মিন করে বলা না। শেখ হাসিনার (ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী) ১৬ বছরে নাগরিক সমাজের দু’একজন ছাড়া কেউ আমার মতো নিরবচ্ছিন্নভাবে রাস্তার আন্দোলনে থাকেনি, অবিরাম লিখে-বলে তার দুঃশাসনের প্রতিবাদ করেনি। তাহলে এটা কাদের উদ্দেশ্যে বলা হয়?"
এদিকে ডেইলি স্টারের সাংবাদিকরা বলছেন, গত ২৬শে জুন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর বিরুদ্ধে 'পক্ষপাতিত্বের' অভিযোগ তোলেন। ডেইলি স্টার প্রসঙ্গে তিনি একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেন, প্রমাণ চাওয়া হলে তিনি দিতে পারবেন। এ বিষয়ে আইন উপদেষ্টার কাছে তথ্য-প্রমাণ আছে। এসব বিষয়ে তথ্য-প্রমাণের জন্য যোগাযোগ করলে আইন উপদেষ্টা বিস্তারিত তথ্য দিতে পারেননি বলে সুখবরকে জানান পত্রিকাটির শীর্ষপর্যায়ের অন্তত চার সাংবাদিক।
তথ্যমতে, মাহফুজ আনাম গত ১৬ই মে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত কলাম লেখেন, 'হোয়াট আর উয়ি বিল্ডিং আফটার ডিজমান্টলিং দ্য আওয়ামী লীগ রেজিম' শিরোনামে। এতে তিনি বলেন, 'উপদেষ্টাদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টনের দিকে তাকালেই বর্তমান বিশৃঙ্খলার একটি চিত্র স্পষ্ট হয়। ...আমরা আইন এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ন্যস্ত করেছি একজনের কাঁধে। ফলাফল, আমাদের দেশে সাংবাদিকরা হত্যা মামলার আসামি এবং আইনি ব্যবস্থা পরিণত হয়েছে নাগরিকদের হয়রানি, ভয় দেখানো ও অর্থ আদায়ের অস্ত্রে।'
তার কলাম যেদিন প্রকাশিত হয়, সেদিন আইন উপদেষ্টা মালয়েশিয়া সফরে ছিলেন। উপদেষ্টা সেখানে শ্রমিকদের উদ্দেশে মন্তব্য করেন, 'আমার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করুন' এবং তার ই-মেইল ও মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে নিতে বলেন। বিষয়টির কড়া সমালোচনা করে কলামে মাহফুজ আনাম প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অন্য কোনো উপদেষ্টাকে দেওয়ার কথা বলেন। তিনি লেখেন, 'যে প্রবাসী বাংলাদেশিরা গত বছর আমাদের প্রায় ২৩ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার পাঠিয়েছেন এবং অনেক বছর ধরেই প্রায় একই পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়ে যাচ্ছেন, তারা কী একজন আলাদা উপদেষ্টা পেতে পারতেন না?'
খবরটি শেয়ার করুন