ছবি - সংগৃহীত
রবিউল হক
চর্যাপদ শুধু বাংলা সাহিত্যে আদি নিদর্শন নয়, এটি বর্তমান বাউল সাধকদের নিকট আদি ভাবসম্পদ হিসেবে গণ্য। চর্যার কবিগণ ছিলেন একাধারে আচার্য, পণ্ডিত, ভিক্ষু, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারক, ধর্মগুরু এবং উচ্চমার্গীয় ভাবসাধক। আর তাইতো, চর্যাপদ এতো প্রাচীন হবার পরও বর্তমান ভাবসাধকগণের নিকট এক পবিত্র সাধনামার্গ হিসেবে বিবেচ্য। আধুনিক বাংলায় যে ভাবার্থ পাওয়া যায় তার সাথে বর্তমান সাধুগুরুরা নিজের চিন্তাভাবনার খুব চমৎকার মিল খুঁজে পান। তাই নিজেদের ভাবনার সাথে যে সুর খেলা করে সেই সুরেই চর্যার গানগুলো গেয়ে থাকেন। যদিও চর্যার পদগুলোয় বিভিন্ন রাগ-রাগিনীর উল্লেখ করা আছে, কিন্তু অধিকাংশ রাগ-রাগিনীর বর্তমানে কোনও অস্তিত্ব নেই।
চর্যাপদের বিভিন্ন গানে পদকর্তাগণ পটমঞ্জুরী, বঙ্গাল, কামোদ, দেশাখ, ভৈরবী, মল্লারী, গুঞ্জরী, রামক্রী ও বরাড়ী প্রভৃতি রাগের ব্যবহার করেছেন। এর মধ্যে ভৈরবী, দেশাখ রাগ ছাড়া বাকি রাগ-রাগিনীগুলোর ব্যবহার এখন আর হয় না বললে চলে। চর্যাগীতি ছিল ত্রিধাতুক প্রবন্ধগীতি যাতে উদগ্রাহ, ধ্রুব ও আভোগের ব্যবহার ছিল। এছাড়া চর্যাপদ একাধিক চরণযুক্ত, অন্তমিলযুক্ত ও গীতিধর্মী ছিল। তবে চর্যাপদে রাগ-রাগিনীর উল্লেখ থাকলেও কোনও স্বরলিপি ছিল না বা কিভাবে গাইতে হবে তার কোনও নির্দেশনা নেই।
আরও পড়ুন : চর্যাপদ পুনর্জাগরণের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন ভাবসাধকেরা
আবার পদকর্তাদের রচনায় একাধিক জায়গায় লোকরাদ্যের উল্লেখ থাকায় বোঝা যায় তারাও বর্তমান ভাবসাধকদের মতোই ভাব সাধনায় মগ্ন থাকতেন। তারাও নিশ্চয় সহজ-সরল সুরে সাধনা সংগীতের বাণী ও সুর সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেন। আর তাই বর্তমানে পাহাড়পুর ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের বাউল সাধকগণ সহজ-সরল মাটির সুরে চর্যাপদ গেয়ে চলেছেন।
তাদের ভাষ্যমতে, চর্যাপদ তো তখনকার সাধকদের সাধনার সংগীত ছিল আর বাংলা ভাবার্থ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় এটা বাউল সাধকদের গান। মোটকথা চর্যার বাণী যদি সহজ-সরল মাটির সুরে, চর্যার এই উৎসভূমির সুরে পরিবেশন করে এর ভাব বাণী সকল মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তো কোনও সমস্যা হবার কথা নয়। আমাদের আদি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য শুধু একটি মহলের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে নদীর গতিময়তার মতোই তার আপন গতিপথ বেছে নিবে আর এদেশের আদি ভাবসম্পদ দেশজ সুরে, লোকজ সুরে চর্যার চর্চা চালিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক বলে আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।
রবিউল হক, লোক গবেষক ও শিল্পী
আই.কে.জে/