ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের গাজা অভিমুখে যাত্রা করা ত্রাণবাহী নৌবহর ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়েছে। বহরের প্রায় সব নৌযানে থাকা অধিকারকর্মীদের আটক করেছে ইসরায়েল। তাদের মধ্যে রয়েছেন সুইডিশ অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ। ইসরায়েলের এমন পদক্ষেপকে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ উল্লেখ করে নিন্দা জানিয়েছে অনেক দেশ। বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভও হয়েছে। খবর রয়টার্স ও আল জাজিরার।
বাংলাদেশ সময় গতকাল বৃহস্পতিবার (২রা অক্টোবর) রাত সাড়ে ১১টায় গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ৪২টি নৌযানের মধ্যে মাত্র একটি তখন পর্যন্ত ইসরায়েলি বাধা এড়িয়ে গাজা অভিমুখে এগিয়ে যাচ্ছিল।
অন্য নৌযানগুলোয় থাকা অন্তত ৪৪৩ জন অধিকারকর্মীকে আটক করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। একটি বাদে ফ্লোটিলার সব নৌযান থামিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসরায়েলও। নৌযানগুলোতে গাজাবাসীর জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খাদ্য, চিকিৎসাসামগ্রী, তাঁবু ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ছিল।
গাজায় প্রায় দুই বছর ধরে ইসরায়েলের ব্যাপক নৃশংসতার মধ্যে ত্রাণবাহী এই নৌবহর আটকে দেওয়ার ঘটনা ঘটল। গত দুই বছরে উপত্যকাটিতে ৬৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। পাশাপাশি ইসরায়েলের অবরোধে সেখানে দেখা দিয়েছে খাবারের তীব্র সংকট। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজার বাসিন্দারা প্রতিদিন প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র ২৬ শতাংশ খাবার পাচ্ছেন।
এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের অবরোধ ভেঙে ভূমধ্যসাগর দিয়ে গাজায় ত্রাণ সরবরাহ করতে যাচ্ছিল গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা। অনেকটা প্রতীকী হলেও ওই বৈশ্বিক প্রচেষ্টা বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। চারটি বৈশ্বিক জোট গ্লোবাল মুভমেন্ট টু গাজা (জিএমটিজি), ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এফএফসি), মাগরেব সুমুদ ফ্লোটিলা ও সুমুদ নুসানতারা।
বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলোকচিত্রী ও দৃক গ্যালারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল আলম ঢাকায় গত ২৭শে সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, তিনি ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের মিডিয়া ফ্লোটিয়ায় যোগ দিচ্ছেন। গাজামুখী একটি নৌযান থেকে শহিদুল আলম গতকাল রাত সাড়ে সাতটার দিকে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি ভিডিও প্রকাশ করেন।
ভিডিওতে তিনি অসুস্থতা বোধ করার কথা জানান। তিনি বলেন, সমুদ্র খুবই উত্তাল হয়ে আছে। তিনি আশা করছেন, দ্রুত এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠবেন।
গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা ছোট ছোট অনেক নৌযান নিয়ে ৩১শে সেপ্টেম্বর স্পেন থেকে ত্রাণ নিয়ে গাজা অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। পরে তিউনিসিয়া, ইতালি ও গ্রিস থেকে বহরে আরও নৌযান যুক্ত হয়। শেষ পর্যন্ত নৌযানের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০টির বেশি।
সব ঠিকঠাক এগোলে গাজার স্থানীয় সময় গতকাল সকালে নৌবহরটির উপত্যকায় পৌঁছানোর কথা ছিল ফ্লোটিলার। তবে এর আগে বুধবার রাতে নৌবহরে হানা দেয় ইসরায়েলি বাহিনী। ভূমধ্যসাগরে গাজা উপকূল থেকে ১২৯ কিলোমিটার (৭০ নটিক্যাল মাইল) দূরে প্রথম ইসরায়েলের বাধার মুখে পড়ে তারা। নৌবহরের নৌযানগুলোকে যাত্রাপথ পরিবর্তনের নির্দেশ দেওয়া হয়।
এর কিছুক্ষণ পর ইসরায়েলি নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে সেনারা নৌযানগুলোয় একে একে প্রবেশ শুরু করেন। বন্ধ করে দেওয়া হয় নৌযানগুলোর যোগাযোগব্যবস্থা। সেগুলো লক্ষ্য করে জলকামান দিয়ে ছোড়া হয় পানিও। নৌযানগুলো থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা ভিডিওতে অধিকারকর্মীদের দিকে বন্দুক তাগ করে রাখতে দেখা যায় ইসরায়েলি সেনাদের।
ফ্লোটিলার নৌযানগুলোয় প্রায় ৪৪টি দেশের প্রায় ৫০০ আরোহীর মধ্যে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচিত প্রতিনিধি, আইনজীবী, অধিকারকর্মী, চিকিৎসক ও সাংবাদিকেরা। নৌযানগুলো থামিয়ে দেওয়ার সময় অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গসহ তাদের আটক করা হয়।
থুনবার্গকে আটক করা হয় বুধবার রাতে। বৃহস্পতিবার তার একটি ভিডিও বার্তা প্রকাশ করে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা। আগে ধারণ করা ওই ভিডিওতে তিনি বলেন, ‘আমাকে অপহরণ করা হয়েছে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইসরায়েলি বাহিনী আমাকে নিয়ে গেছে। আমাদের মানবিক যাত্রাটি ছিল অহিংস এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী। সরকারকে আমার ও অন্যদের অবিলম্বে মুক্তির দাবি জানাতে বলুন।’
ইসরায়েলের হানার পর ফ্লোটিলার কয়েকটি নৌযান ইসরায়েলের আশদোদ বন্দরে নেওয়া হয়। গতকাল রাতে সেখানে অন্তত তিনটি নৌযান অবস্থান করছিল বলে জাহাজ চলাচলের তথ্য সরবরাহকারী ওয়েবসাইট মেরিন ট্রাফিকে দেখা গেছে। এগুলো হলো ক্যাপ্টেন নিকোস, এস্ত্রেইয়া ইমানুয়েল ও আদারা। এর মধ্যে ক্যাপ্টেন নিকোসে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের আইনপ্রণেতা ছিলেন।
আটক আরোহীদেরও আশদোদ বন্দরে নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানিয়েছিল ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। থুনবার্গসহ অন্যরা ‘নিরাপদ ও সুস্থ’ আছেন বলে উল্লেখ করে তারা। পরে জাতিসংঘে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন বলেন, ইসরায়েলে ইয়ম কিপুর উৎসব উপলক্ষে ছুটি চলছে। ছুটি শেষে নৌযান থেকে আটক অধিকারকর্মীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে।
সে পর্যন্ত অধিকারকর্মীদের দক্ষিণ ইসরায়েলে উচ্চ নিরাপত্তার কোতজিওত কারাগারে রাখা হতে পারে বলে জানিয়েছেন প্যারিসের সায়েন্সেস পো ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক আইনবিশেষজ্ঞ ওমের শাৎজ। তিনি বলেন, এত অধিকারকর্মীকে অন্যত্র আনা–নেওয়াটা বেশ কঠিন। তাই তাদের কোতজিওত কারাগারে রাখা হতে পারে। প্রতিকূল পরিবেশের জন্য এই কারাগারের কুখ্যাতি রয়েছে।
তবে ফ্লোটিলার আরোহীদের দীর্ঘ সময় আটকে রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন–গভির। আর ইসরায়েলি মানবাধিকার গোষ্ঠী ‘আদালাহ’ জানিয়েছে, আগেও গাজার দিকে রওনা দেওয়া বিভিন্ন নৌবহর থেকে অধিকারকর্মীদের আটক করেছিল ইসরায়েল। তাদের চেয়ে এবার আটক অধিকারকর্মীদের কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হতে পারে।
ত্রাণবাহী এই নৌবহর আটকে দেওয়ার মাধ্যমে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে বলে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, কোনো দেশের উপকূল থেকে সমুদ্রের গভীরে ২২ কিলোমিটার এলাকার নিয়ন্ত্রণ এবং পূর্ণ সার্বভৌমত্ব থাকে ওই দেশের। এরপর আরও ৩৭০ কিলোমিটার এলাকা বা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে কিছু কার্যক্রম চালাতে পারে ওই দেশ।
খবরটি শেয়ার করুন