ছবি- সংগৃহীত
চিকিৎসা হলো একটি মহান সেবা, কোনো পণ্য নয়। কিন্তু এখন এদেশে কিছু ব্যক্তি চিকিৎসা সেবাকে পণ্যে পরিণত করেছেন। এজন্য প্রতিবছর এ দেশের অসংখ্য মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান। এদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা যদি ভালো হতো, তাহলে রোগীরা নিশ্চয়ই বিদেশে গিয়ে টাকা খরচ করতেন না। দেশের টাকা দেশেই থাকত। বিদেশে চিকিৎসার কারণে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বাইরে চলে যাচ্ছে। এভাবে টাকা না গেলে তা জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ হতো।
বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থায় এখনো আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করেনি। এর অন্যতম কারণ হলো, চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে কখনোই যুগোপযুগী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। চরম অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণেই এই খাতটির এত রুগ্ন দশা।
অথচ চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার হলেও বরাবরই এ দেশের মানুষ তা থেকে অনেকটা বঞ্চিত। সরকারি হাসপাতালগুলোতে যথাযথ চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা নেই। কোথাও ব্যবস্থা থাকলেও অতিরিক্ত রোগীর চাপে সেবাবঞ্চিত হচ্ছে। সরকারি হাসপাতাল নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। সরকারি হাসপাতালে টাকা ছাড়া সেবা মেলে না, ঘুষ ছাড়া সিট মেলে না এবং অপারেশনের সিরিয়াল পাওয়া যায় না। দেখা যাচ্ছে, অনেক ব্যয়বহুল চিকিৎসা সরঞ্জাম পড়ে থাকলেও তা যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয় না।
সরকারি হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার কারণে অনেকে বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালে যায়। কিন্তু সেখানে রোগীদের জিম্মি করে অর্থ হাতিয়ে নেয়। এদেশে যে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যে নেই, তা বলা যাবে না। কিন্তু তারা অনেক ক্ষেত্রে রোগীর সঠিক রোগ নির্ণয় করতে পারেন না। অনেক সময় অভিযোগ পাওয়া যায় নামীদামী হাসপাতালেও টেস্ট করে অনেক জটিল রোগের কথা বলা হয়। কিন্তু দেশের বাইরে গিয়ে যখন পুনরায় টেস্ট করা হয় তখন রোগও পরিবর্তন হয়ে যায়। এর কারণ কি রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রের ত্রুটি, নাকি চিকিৎসক ও হাসপাতালের মিলিত কারসাজি!
সরকারি হাসপাতালের পাশেই ব্যাঙের ছাতার মতো দেশে বেসরকারি হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না নিয়ে দেদার চলছে অনেক বেসরকারি হাসপাতাল। সরকারিভাবে মনিটরিং না হওয়ায় সেখানে সামান্য রোগের কারণে মৃত্যু হওয়ার মতো অভিযোগও নানা সময় উঠেছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে গলা কাঁটার ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে।
দেশে চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল বলেই অনেকে বিদেশমুখী হচ্ছে। যে টাকা দিয়ে এখানে চিকিৎসা হয়, তারচেয়ে অনেক কম টাকায় কলকাতা, মাদ্রাজ, ব্যাঙ্গালোর কিংবা ভারতের অন্য কোনো রাজ্যে চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়। আবার অনেকে আছেন, যাদের দেশে চিকিৎসা করানোর অর্থনৈতিক সমস্যা নেই, তাদের আস্থাহীনতা রয়েছে। তারা মনে করেন, দেশে ভালো চিকিৎসা হয় না। বিদেশে চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভারত ছাড়াও ধনীদের তালিকায় সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়, যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশও আছে।
বিদেশগামী রোগীদের সবচেয়ে বড় গন্তব্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। দ্রুত ও সহজলভ্য যোগাযোগের কারণেই ভারতে বেশি রোগী যায়। স্থলপথ ও রেলপথে ভারতে যাওয়া যায়। এ সুবিধা অন্য কোনো দেশের ক্ষেত্রে নেই। তাছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের মানুষের খাবার-দাবার, ভাষা এবং সংস্কৃতির অনেক মিল রয়েছে।
এক দেশ থেকে অন্য আরেক দেশে সুলভ মূল্যে সুচিকিৎসার আশায় ভ্রমণ করাকে বলা হয় চিকিৎসা পর্যটন। কোনও একটি দেশ নিজেকে চিকিৎসা পর্যটনের গন্তব্যে পরিণত করতে চাইলে প্রথম শর্ত হলো দেশটিকে সুলভ মূল্যে উন্নত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা। ভারত সেই কাজটি করতে পেরেছে। সে কারণেই শুধু বাংলাদেশি রোগী নয়, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রোগী ভারতে চিকিৎসা নিতে আসেন। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাস্থ্যের অনেক সূচকে এগিয়ে থাকলেও একটি ভালো মানের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারেনি। যার কারণে প্রতিনিয়ত মানুষ চিকিৎসা নিতে বাইরে যাচ্ছে।
দেশের চিকিৎসা সেবার প্রতি রোগীদের আস্থার সংকট দূর করতে প্রথমেই জবাবদিহিতা প্রয়োজন। সরকারি হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে নজরদারি বাড়াতে হবে। এসব বিষয়ে সরকারকে দ্রুত সমস্যা সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
আই.কে.জে/