ছবি: সংগৃহীত
কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক ড. গোলাম কিবরিয়া পিনু দশকের পর দশক ধরে বাংলা সাহিত্যে সৃজনশীল স্পর্ধা নিয়ে সমানভাবে অবিচল। দশকওয়ারি বিভাজন করলে তিনি আশির দশকের দেশবরেণ্য নিভৃতচারী কবি। সমসাময়িক কবিদের মধ্যে দুই বাংলা মিলিয়ে অন্যতম শুদ্ধতম কবির প্রতিচ্ছবি তিনি। তার কবিতা বর্ণিল, সেগুলো বিভিন্ন নিরীক্ষাপ্রবণতায় সংশ্লিষ্ট। পিনুর কবিতায় আছে জীবন, সমাজ, প্রকৃতি, মানুষ, দেশ-কাল। আছে প্রতীকের ব্যঞ্জনা, রূপক। আছে ছন্দের বিভিন্নমুখী ব্যবহার, অনুপ্রাসের নতুনমাত্রা, মিলবিন্যাসের নিরীক্ষা ও অন্যান্য সূক্ষ্ম কারুকাজ।
কবিতাবোদ্ধারা বলেন, গোলাম কিবরিয়া পিনুর একেক কাব্যগ্রন্থ একেক বৈশিষ্ট্য নিয়ে উজ্জ্বল। তার কবিতায় উৎপিপাসু পাঠক বিভিন্ন ভূগোলের খোঁজ পেয়ে থাকেন। তার কবিতা পাঠকের সংবেদন সৃষ্টি করে একধরনের ইন্দ্রিয়ানুভূতিও তৈরি করে, যা ইন্দ্রিয়জ্ঞানে পরিণত হয়, সেই সাথে কবিতার শিল্প-সৌন্দর্য নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ও আনন্দময় অনুভূতিরও জন্ম দেয়। কাব্যরসের দ্যোতনা সৃষ্টি করে। অমর একুশে বইমেলা সামনে রেখে সুখবর ডটকম মুখোমুখি হয়েছিল নন্দিত এই কবির। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুখবরের বিশেষ প্রতিবেদক।
কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু বলেন, ‘অমর একুশের বইমেলা কয়েক বছর হলো বড় পরিসরে আয়োজন করা হচ্ছে। এতে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা কাটানো সম্ভব হচ্ছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলার সম্প্রসারণের ফলে হাঁটাচলা ও অন্যান্য সুবিধা বেড়েছে। বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চেতনাগত দর্শন ও ইতিহাসের মধ্যেও এক ধরনের সংহতি খুঁজে পাচ্ছি, যা জাতীয় চেতনার মূলভূমিরই কণ্ঠলগ্ন হয়ে আছে।’
তিনি বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে এবার প্রকাশনা বিভিন্ন কারণে বাড়বে বলে মনে হয় না। কাগজসহ প্রকাশনার বিভিন্ন উপকরণের দাম যেমন বেড়েছে, তেমনি প্রকাশনা শিল্পের সংকটও বেড়েছে বলে মনে হয়। তবে বইমেলার যে অন্তঃপ্রাণ প্রকাশনা, সেই প্রকাশনা শিল্পের এখনো অনেক সীমাবদ্ধতার কারণে লেখক ও প্রকাশকের পেশাদারিত্বের বিষয়টি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘লেখকের পাণ্ডুলিপি গ্রহণ ও বিবেচনা করার ক্ষেত্রে অনেক প্রকাশকের আগ্রহ ও নিয়ম-নীতির অভাব রয়েছে। সম্মানি ও অন্যান্য দিকও বিবেচনা করা হয় না। প্রকাশকও বেড়েছে, লেখকও বেড়েছে। কিন্তু উভয়ের মঙ্গলের জন্য আরও বোঝা-পড়ার গভীরতা বাড়ানো দরকার। আমাদের বইয়ের প্রকাশনার মান বাড়ছে, লেখার মানও বাড়ছে, তা আরও শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো প্রয়োজন।’
তিনি মনে করেন, ‘বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিনের জায়গাটা আগের বছরেও অবহেলার শিকার হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। এবার এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের আরও নজর দেওয়া উচিত। আর মোড়ক উন্মোচনের স্থান, পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা বেশ অগোছালো থাকে। সেইদিকেও নজর দেওয়া উচিত। জানি না, যারা প্রকৃত সাহিত্য সাধনার সাথে যুক্ত, তাদের জন্য বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠান কতটুকু অবারিত থাকবে? নাকি পূর্বের সব আমলের মতোই তা আরও সংকীর্ণ ভেদবুদ্ধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে, তা দেখারও বিষয়।’
তিনি বলেন, ‘বইমেলার সাথে মিডিয়ার জড়িয়ে পড়ার ভূমিকা ও আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। বই-লেখক নির্বাচন ও আবিষ্কারের বিষয়টির অভাব রয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন রচনার জন্য আরও এগিয়ে আসা উচিত। তাহলে বই ও লেখক নির্বাচনে পাঠকরা উপকৃত হবেন। কিন্তু তা না হয়ে দেখা যাচ্ছে, টিভি চ্যানেলগুলোর বেশিরভাগ মেলার মাঠ থেকে সরাসরি তাদের অনুষ্ঠান পরিচালনা করে। যে কেউ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে কয়েক সেকেন্ড বই হাতে নিয়ে সেসব অনুষ্ঠানে সহজেই নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেন। তাতেই তারা কেউ কেউ ধন্য হয়ে যান।’
তিনি বলেন, ‘এই প্রবণতায় দেখা যাচ্ছে, কেউ কেউ এ ক্ষেত্রে নতুন বইকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। এই সব প্রচারের ফাঁদে পড়েও কেউ কেউ মান ছাড়া বই বের করতে আজকাল বেশ উৎসাহী হচ্ছেন! কেউ কেউ হয়তো এক-ঝলক চেহারা দেখিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করে থাকেন। কেউ কেউ হয়তো ভাবেন, এভাবে লেখার জগতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবেন। সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করেন! কিন্তু এতে কবি, লেখক ও লেখার কতটুকু মর্যাদা বাড়ে, তা বিবেচনার বিষয়।’
তিনি বলেন, ‘বই তো জরুরি। সভ্যতা বিকাশের জন্য তা বিকল্পহীন। বই আমাদের সবার বেড়ে ওঠার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে। আমাদের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার হার অনেক বেড়েছে। সেই কারণে পাঠ্যবইয়ের সাথে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন নয়। তবে পাঠ্যবইয়ের বাইরেও ব্যক্তির মননশীলতার জন্য অন্যান্য বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য কবিতা, গল্প থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ আছে।’
কবি বলেন, ‘বইবান্ধব সমাজ আমাদের সবারই কাম্য। এই কারণে বইমেলার আয়োজনও গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। বইয়ের মধ্য দিয়ে রুচি, কল্পনা, নৈতিকতাবোধ, সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ, সৃজনশীলতা ও অন্যান্য বহুবিধ চেতনার উন্মীলন হয়। সেসব ছাড়া এই সভ্যতার অগ্রগতি সম্ভব নয়।’
তিনি পাঠকদের উদ্দেশ করে জানান, ‘‘অমর একুশে বইমেলা ২০২৫, এতে আমার একটি কবিতার বই বের হচ্ছে। নাম- ‘জামাটা পাল্টাও, অন্তর্বাসও’। প্রকাশক-অনুপ্রাণন। এছাড়া গত বছরে প্রকাশিত বইসহ অন্যান্য বছরের বইগুলো এবারও বিভিন্ন প্রকাশনীর স্টলে পাওয়া যাবে।’’
শান্তনু/ আই.কে.জে/