কামাল আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শেষদিন ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত এলাকা যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে বিবিসি আই সম্প্রতি একটি অনুসন্ধানীমূলক প্রতিবেদন প্রচার করেছে। তাদের এ প্রতিবেদন দেশ-বিদেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশের পাঠকদের মধ্যে আলোচিত হয়। বিবিসির সাবেক সাংবাদিক ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ মনে করেন, যাত্রাবাড়ীর ঘটনা সম্পর্কে বিবিসির এ অনুসন্ধান 'ত্রুটিপূর্ণ ও কিছুটা বিভ্রান্তিকর'। কাজটি করেছে বিবিসি ইন্ডিয়া, যা দিল্লিকেন্দ্রিক কোম্পানি। তারা বিবিসির হয়ে কাজ করে, কিন্তু তাদের সম্পাদকীয় স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
কামাল আহমেদ বলেন, "বিবিসির 'দ্য ব্যাটল ফর বাংলাদেশ: ফল অব শেখ হাসিনা' শিরোনামের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বেশ প্রশংসিত হয়েছে। সম্ভবত এর প্রধান কারণ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম হিসেবে বিবিসির সুনাম ও ব্যাপক পরিচিতি। কিন্তু অনুসন্ধানের বিচারে নতুন কী তথ্য পাওয়া গেল? শেখ হাসিনা (অভ্যুত্থানে গত ৫ই আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী) মারণাস্ত্র ব্যবহার ও হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার অনুমতি দিয়েছিলেন- এটা নতুন কোনো তথ্য নয়, বরং আগেই প্রকাশিত অডিওর ফরেনসিক পরীক্ষায় সেটা যে এলো, তা নিশ্চিত করা হয়েছে।"
তিনি বলেন, 'নতুন দুটি উপাদান এতে (বিবিসি আইয়ের প্রতিবেদন) আছে। একটা হলো যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনে শহীদ হওয়া মিরাজের (মিরাজ হোসেন) মুঠোফোন সেটে ধারণ করা ফুটেজ এবং যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশের ভাষ্য, যার মধ্যে তখনকার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বর্তমানে জেলে থাকা আবুল হাসানের বক্তব্যও রয়েছে।'
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে শুক্রবার (১১ই জুলাই) রাত ৯টার দিকে দেওয়া এক পোস্টে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট কামাল আহমেদ এসব কথা বলেন। ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি কর্তৃপক্ষের ভেরিফায়েড নয়, তবে সুখবর ডটকম নিশ্চিত হয়েছে অ্যাকাউন্টটি ওই সাংবাদিকের।
কামাল আহমেদ পোস্টে লেখেন, 'যাত্রাবাড়ীর ঘটনা সম্পর্কে বিবিসির অনুসন্ধান ত্রুটিপূর্ণ এবং কিছুটা বিভ্রান্তিকর। ইন্টারন্যাশনাল ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস প্রজেক্ট (আইটিজেপি) কয়েকমাস আগেই যাত্রাবাড়ীর ঘটনার অনেক ভিডিও ফুটেজের ফরেনসিক বিশ্লেষণ, গোলাবারুদের ব্যবহার সম্পর্কে সামরিক ও অস্ত্র বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ এবং স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে তুলে এনেছিল, সেখানে কী ঘটেছে।'
তিনি বলেন, 'ওই প্রতিবেদনে (আইটিজেপি) দেখা গেছে, ৫ই আগস্ট থানার সামনে (যাত্রাবাড়ী থানা) জনতা এবং ভেতরের পুলিশের মাঝখানে সেনাবাহিনীর একটি দল সুরক্ষা দেয়াল করে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই পুলিশ ভবনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে এবং সেনাবাহিনীর পেছন থেকে জনতার উদ্দেশ্যে একটি গ্রেনেড বা বোমা ছোঁড়ে এবং তারপর এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে জনতাকে তাড়া করে। সেনাবাহিনী তখন সরে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু বিবিসি সেটা বলেনি, তারা সেনাবাহিনীর সরে যাওয়াকে রহস্যজনক হিসেবে দেখিয়েছে এবং পুলিশের গুলিবর্ষণকেও ঘেরাও পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষামূলক হিসেবে তুলে ধরেছে।'
প্রসঙ্গত, বিবিসি আইয়ের ওই প্রতিবেদনে এ বিষয়ে সেনাবাহিনীর কোনো বক্তব্য নেই। যা প্রতিবেদনটির 'বিশেষ দুর্বল দিক' বলে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের অভিমত। তারা বলছেন, গত বছরের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে ভারতীয় কিছু সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে আসছে। এর একটা 'প্রভাব' 'বিবিসি আইয়ের' ওই প্রতিবেদনে লক্ষ্যণীয়। অবশ্য প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, 'ওই ঘটনার সময় সেনাসদস্যদের ভূমিকার বিষয়ে মন্তব্য জানতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।'
কামাল আহমেদ বলেন, 'এটি অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর এবং দায়িত্বহীন কাজ (বিবিসির)। তারা আইটিজেপির প্রতিবেদন না দেখে থাকলে তা তাদের ক্ষমাহীন ভুল।' তিনি উল্লেখ করেন, 'ওহ্, আরেকটা কথা। যারা বিবিসি আইকে বিবিসির ইনভেস্টিগেশন ইউনিট ভেবেছেন, তারা সম্ভবত খেয়াল করেননি যে, কাজটি করেছে বিবিসি ইন্ডিয়া, যা দিল্লিকেন্দ্রিক কোম্পানি। তারা বিবিসির হয়ে কাজ করে, কিন্তু তাদের সম্পাদকীয় স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।'
ওই ফেসবুক পোস্ট দেওয়ার প্রায় দুই ঘণ্টা পর কামাল আহমেদ এতে 'সংশোধনী' যোগ করেন। তিনি লেখেন, 'বিবিসি বাংলা থেকে আমাকে জানানো হয়েছে মূল ফিল্মটি বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস লন্ডন থেকেই তৈরি হয়েছে। বিবিসি নিউজ ইন্ডিয়া তার একটি ভার্সন তৈরি করে নিয়েছে, যেখানে কোনো তথ্যগত পরিবর্তন ঘটানো হয়নি। আমি আগে লিখেছিলাম, বিবিসি আই মানে ইনভেস্টিগেশন নয়, দিল্লিস্থ বিবিসি ইন্ডিয়া। সেটাও ঠিক নয় বলে তারা জানিয়েছে। আমি যে ভিডিওটি দেখেছি, এর শেষে বিবিসি নিউজ ইন্ডিয়া লেখা আছে। ভিডিওটি নিচে যোগ করে দিলাম।' পোস্টের সঙ্গে তিনি ওই লিংকও যুক্ত করেন।
উল্লেখ্য, ইন্টারন্যাশনাল ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস প্রজেক্ট (আইটিজেপি) ‘ব্লাডশেড ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে ২০২৪ সালের জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে গত জানুয়ারি মাসে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কয়েকদিন পর থেকে সংস্থাটি এসব প্রমাণ সংগ্রহ করতে মাঠে নামে।
খবরটি শেয়ার করুন