স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, বীর মুক্তিযোদ্ধা আপেল মাহমুদ। ছবি: সংগৃহীত
রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও অনুপ্রেরণা জোগানো কালজয়ী গানগুলোর অন্যতম ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি...’ এর সুরকার ও গায়ক আপেল মাহমুদ। তিনি সবার কাছে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত। একুশে পদকজয়ী এ শিল্পীকে নিয়ে সম্প্রতি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) অভিযোগ এসেছে যে, তিনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন। বিজয়ের প্রায় ৫৪ বছর পর ওঠা এ অভিযোগ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
সাংবাদিক, প্রেস ইন্সটিটিউটের (পিআইবি) সাবেক মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ আওয়ামী লীগের সরকারের সময়ে একাধিকবার অভিযোগ করেন, 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের একজন আপেল মাহমুদ। আপেল মাহমুদ ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের আগের রাতে বেতার স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন। তিনি রেডিও ট্রান্সক্রিপ্টের চাবি নিয়ে রেখেছিলেন, ১৫ই আগস্টের সকালে তিনি বারবার ডালিমের রেকর্ড বাজাচ্ছিলেন। তার বাসায় শেখ মুজিবকে হত্যার পরিকল্পনা করে কয়েকবার সভা হয়।'
জামুকার কাছে আপেল মাহমুদ মুক্তিযোদ্ধা নন বলে যে অভিযোগ এসেছে, এর সঙ্গে শেখ মুজিবকে হত্যার পরিকল্পনার বিষয়ে তার বাসায় ‘সভা’ হওয়ার কোনো সম্পর্ক আছে কী না, মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে তার বিরুদ্ধে লিখিত তথ্য-উপাত্ত আছে কী না, হঠাৎ করে এমন অভিযোগ কেন উঠেছে, এসব বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে সুখবর ডটকম।
অনুসন্ধান বলছে, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতাসহ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী চার শতাধিক রাজনীতিবিদের (এমএনএ-এমপিএ) মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল মঙ্গলবার (৩রা জুন) রাতে জাতীয় কয়েকটি দৈনিক পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে এমন প্রতিবেদন প্রচারিত হয়। এরপর থেকে দেশ-বিদেশে অন্যতম ইস্যু হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিলের প্রসঙ্গ। যদিও আজ বুধবার (৪ঠা জুন) সরকার স্পষ্ট করেছে, ওই প্রতিবেদনগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা। সনদ 'বাতিলের' এ আলোচনাায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপেল মাহমুদও অন্তর্ভুক্ত।
তবে চার শতাধিক রাজনীতিবিদের স্বীকৃতি 'বাতিলের' আগে থেকেই আপেল মাহমুদ মুক্তিযোদ্ধা কী না, এ আলোচনা চলছে। গত বছরের ৫ই আগস্টের পর জামুকার কাছে আসা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হচ্ছে। ২০২২ সালের ১৪ই আগস্ট জুম কনফারেন্সের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু পরিষদের (আমেরিকা শাখা) আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান আলোচক ছিলেন সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদ। এতে তিনি ঢাকা থেকে সংযুক্ত হয়ে অভিযুক্ত করেন আপেল মাহমুদকে শেখ মুজিবুরের হত্যার 'ষড়যন্ত্রকারী' হিসেবে।
প্রথম আলোর উত্তর আমেরিকার সংস্করণের একটি প্রতিবেদনে জাফর ওয়াজেদের এ বক্তব্যের কথা উল্লেখ আছে। ‘১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যের অনেক চরিত্রের মুখোশ এখনো উন্মোচিত হয়নি, যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুর পরিষদের আলোচনা সভায় পিআইবির মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় ওই বছরের ১৮ই আগস্ট। ঢাকার অন্তত দশজন সাংবাদিক নিশ্চিত করেন, এমন কথা জাফর ওয়াজেদ কয়েকবার ফেসবুকেও লেখেন। কীসের ভিত্তিতে তিনি এমন কথা বলেছেন, সুখবর চেষ্টা করেও তার বক্তব্য জানতে পারেনি।
কারণ, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে জাফর ওয়াজেদ 'নিরাপদ দুরত্বে' আছেন। তার ব্যবহার করা মুঠোফোন নম্বরটিও বন্ধ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তাকে পাওয়া যায় না। তার বিরুদ্ধে 'হত্যাচেষ্টার' মামলা দায়ের হয়েছে। মূলত জামুকায় অভিযোগ আসার খবরকে কেন্দ্র করে আর জাফর ওয়াজেদের দাবিকে 'ভিত্তি' করে অনেকে আপেল মাহমুদ সম্পর্কে নেতিবাচক আলোচনা করছেন। তার বাসায় শেখ মুজিবকে হত্যা পরিকল্পনার 'সভা' অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা জাফর ওয়াজেদ ছাড়া আর কোনো গবেষক, সাংবাদিক ও লেখক কখনোই বলেননি। এমনকি আওয়ামী লীগের কেউই এ অভিযোগ করেননি।
আপেল মাহমুদের মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় নিয়ে গত ৫ই আগস্টের পর স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্মী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মনোয়ার হোসেন অভিযোগ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১২ই মে জামুকার উপপরিচালক (উন্নয়ন) ফাতেমা খাতুন নোটিশ করেন শিল্পীকে। সেই নোটিশে তিনি যে মুক্তিযোদ্ধা, এর পক্ষে যাবতীয় দলিল ও সাক্ষ্য উপস্থাপনের জন্য বলা হয়।
আপেল মাহমুদ কুমিল্লার সন্তান। তিনি ওই জেলার মেঘনা উপজেলার বাসিন্দা। এ জন্য জামুকায় তার বিরুদ্ধে জমা পড়া অভিযোগটির বিষয়ে গত ২রা জুন কুমিল্লা সার্কিট হাউসে শুনানি হয়। এতে আবার প্রমাণিত হয়, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তার কণ্ঠে প্রচারিত গান যেমন রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করে, তেমনি নিজেও পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রহাতে লড়াই করেন বীরদর্পে।
যোগাযোগ করলে আপেল মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, সেটা আমাকে জীবিত থেকেই দ্বিতীয়বার প্রমাণ করতে হয়েছে। আমি মুক্তিযোদ্ধা নই দাবি করে যেই অভিযোগ করা হয়েছে, সেটি ভুল প্রমাণিত হওয়ায় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সদস্যরা দুঃখ প্রকাশ করেছেন।’
এইচ.এস/