অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের ‘সেফ এক্সিট’ (নিরাপদ প্রস্থান, বা নিরাপদে সরে যাওয়ার উপায়) নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের মন্তব্যে 'তোলপাড়' চলছে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব বিষয়টিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে এবং রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। হঠাৎ করে কেন এনসিপির নেতারা এই প্রসঙ্গ তুললেন, সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বিএনপির নেতাদের মনে। সত্যিই কোনো কোনো উপদেষ্টা তলে তলে সেফ এক্সিটের তালাশ করছেন কী না, করলে কোন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে তা করছেন, এ বিষয়ে আরো খতিয়ে দেখতে চায় দলটি।
বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছে, উপদেষ্টাদের দায়িত্ব পালন করতে না পারার ব্যর্থতা থেকে 'সেফ এক্সিটের' প্রশ্ন এলে সেটি মূলত একটা অনিয়মতান্ত্রিক পরিবর্তনের কথাই বোঝায়। এ ক্ষেত্রে সরকারের মূল যে দায়িত্ব ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা, এর সঙ্গে মিলিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ করছে দলটি। মুখে না বললেও আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন নিয়ে বিএনপির মধ্যে এখনো কিছু সন্দেহ রয়ে গেছে। সেফ এক্সিটের আলোচনা সেই সন্দেহকে হঠাৎ আরো গাঢ় করছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক সূত্র সুখবর ডটকমকে জানায়, ভেতরে ভেতরে গত কয়েকদিন ধরে দলটির আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু সেফ এক্সিট। পর্দার আড়ালে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা নিয়ে কানাঘুষা চলছে তাদের মধ্যে। এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মন্তব্যের দিকেও নজর রাখছে দলটি। কোনো কোনো উপদেষ্টার এ বিষয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্যের 'ময়নাতদন্ত'ও করছেন দলটির অনেক শীর্ষ নেতা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনায় অংশ নিচ্ছেন দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী। তবে দলের শীর্ষ পর্যায়ের অনেকে এ বিষয়ে আপাতত গণমাধ্যমকে বক্তব্য না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এনসিপি নেতাদের অভিযোগ, উপদেষ্টাদের একটি অংশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সখ্য বজায় রেখে তাদের 'নিরপেক্ষতা' হারিয়েছেন। সুনির্দিষ্ট কোনো উপদেষ্টার নাম এখনই না বললেও তারা মনে করেন, এই উপদেষ্টা পরিষদই জনমানুষের প্রত্যাশাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি এনসিপির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে আলোচনার পরই মূলত সেফ এক্সিটের প্রসঙ্গটি সামনে আনেন এনসিপির নেতারা। দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতা যাদের থাকবে বা কোনো অপরাধ সংগঠিত হলে, সেগুলোর জন্য দেশের যে কোনো নাগরিকের মতোই উপদেষ্টাদের বিচারের আওতায় আনা প্রসঙ্গে দলটিতে আলোচনা হয়।
গত সপ্তাহে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম একটি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে 'সেফ এক্সিট' প্রসঙ্গটি প্রথমে তোলেন। তিনি বলেন, তারা যাদের ওপর (উপদেষ্টা) আস্থা রেখেছিলেন, তাদের দ্বারা গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব প্রতারিত হয়েছে। 'সময় হলে' তাদের নামও প্রকাশ করার কথা জানিয়েছেন তিনি। পরে এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমও একই বিষয়ে বক্তব্য দেন তাদের দলের এক সভায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ধারণা করা হচ্ছে, কয়েক উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে এমন আশ্বাস চাইছেন, যেন ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তনের পর তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা না নেওয়া হয় এবং তারা নিরাপদে দেশ ছাড়তে পারেন।
এ বিষয়ে গত কয়েক দিন উপদেষ্টারা মুখ না খুললেও গত বুধবার (৮ই অক্টোবর) সাংবাদিকদের প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে পারেননি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার পর স্থানাীয় সরকার, সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা কথা বলেন। সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একটি সূত্র বৃহস্পতিবার (৯ই অক্টোবর) সন্ধ্যার পর সুখবর ডটকমকে জানায়, সেফ এক্সিট আলোচনা সামনে আসায় কোনো কোনো উপদেষ্টা বিব্রত। উপদেষ্টাদের মধ্যে কারা সেফ এক্সিট নিতে চান, সেটি নাহিদ ইসলামকেই পরিষ্কার করতে হবে।
স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বুধবার রাতে এক ফেসবুক পোস্টে এ প্রসঙ্গে বলেন, 'যাদের একাধিক দেশের পাসপোর্ট ও নাগরিকত্ব নেওয়া, তারাই আবার অন্যদের সেফ এক্সিটের তালিকা করে। যারা ৫ই আগস্ট পালিয়েছিল, তাদের সিমপ্যাথাইজাররা কষ্টে মরে যাচ্ছে। বারবার ফ্যাসিস্টদেরই পালাতে হবে। আমাদের জন্ম এ দেশে, মৃত্যুও এ দেশের মাটিতেই হবে ইনশাআল্লাহ। ফ্যাসিস্ট, খুনিদের সাথে লড়তে লড়তে আমার ভাইদের মতো শহীদী মৃত্যুই কামনা করি।'
এর আগে বুধবার বিকেলে এ বিষয়ে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেন। জবাবে তিনি বলেন, ‘তার (নাহিদ ইসলাম) বক্তব্য তাকেই সাবস্ট্যান্টসিয়েট (সত্যতা প্রমাণ) করতে হবে। তার বক্তব্যকে আমার সাবস্ট্যান্টসিয়েট করার বিষয় না, আমার খণ্ডানোরও বিষয় না।’ এরপরই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন আসিফ মাহমুদ। প্রশ্ন উঠেছে, একাধিক দেশের পাসপোর্টধারী ও নাগরিক বলে কাকে ইঙ্গিত করলেন তিনি?
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ প্রসঙ্গে বলেন, 'যদি কোনো নেতার অন্তরে সততার আলো থাকে, তার বিরুদ্ধে হাজার অভিযোগ করেও সেফ এক্সিটের দরকার হয় না। খালেদা জিয়ার সেফ এক্সিটের দরকার পড়েনি, কারণ, তিনি অন্তরের আলোতে আলোকিত। তার বিরুদ্ধে অসংখ্য মিথ্যা মামলা হয়েছে, নানা অভিযোগ আনা হয়েছে, কিন্তু তিনি দেশের মাটিতেই থাকতে চেয়েছেন। তিনি কখনোই সেফ এক্সিট চাননি।'
৭২ বছরের বেশি বয়সে এসে সেফ এক্সিটের কথা ভাবতে হলে সেটি দুঃখের বিষয় হবে বলে মনে করেন অন্তর্বর্তী সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক পোস্টে বৃহস্পতিবার (৯ই অক্টোবর) এমন মন্তব্য করেন তিনি। তার পোস্টটি শেয়ার করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। ‘উপদেষ্টার রোজনামচা, চালকের হেলমেট নাই, ও সেফ এক্সিট’ শিরোনামে ফেসবুকে ওই পোস্ট দেন উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। পোস্টের শেষের অংশে ‘সেফ এক্সিট’ প্রসঙ্গে কথা বলেন তিনি।
ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘বিষয়টি উত্থাপনকারী, প্রাক্তন উপদেষ্টা ও বর্তমান এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলাম আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন ও জুলাই আন্দোলনের অগ্রসেনা হিসেবে শ্রদ্ধার পাত্র। তাই তার বক্তব্যের ওপর আমার মন্তব্য করা শোভন নয়। তাছাড়া আমি রাজনৈতিক বিষয়ে কোনো মন্তব্য করি না।’
তিনি আরো বলেন, ‘নিজে পদে থেকে অন্যায় সুবিধা গ্রহণ করিনি। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কাউকে ব্যবসা বা চাকরি দিই নাই। নিজের সীমিত সামর্থ্যের সবটুকু ব্যবহার করে জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছি। শিক্ষকতার সূত্রে, ইতিপূর্বে যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার নিশ্চিত সুযোগ গ্রহণ করিনি। তাই আজ ৭২ বছরেরও বেশি বয়সে আমাকে যদি সেফ এক্সিটের কথা ভাবতে হয় তা হবে গভীর দুঃখের বিষয়।’
উপদেষ্টাদের সেফ এক্সিট প্রসঙ্গে এনসিপির নাহিদ ইসলামের বক্তব্যকে ‘রাজনৈতিক’ বলে মন্তব্য করেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ। তিনি একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে বলেন, ‘উপদেষ্টাদের সেফ এক্সিটের দরকার আছে বলে মনে করি না। একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে এই সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। উপদেষ্টাদের সেফ এক্সিট বা নিরাপদ প্রস্থানের দরকার নেই।’
খবরটি শেয়ার করুন