ছবি: সংগৃহীত
বিশিষ্ট লেখক ও রবীন্দ্র গবেষক প্রবীর বিকাশ সরকার। তিনি প্রবাসে ফেরি করছেন বাংলা সাহিত্য। বিশ্বসাহিত্যের দরবারে বাংলা সাহিত্যকে তুলে ধরে আসছেন দশকের পর দশক ধরে। গবেষণাধর্মী বই লেখালেখি ছাড়াও ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাসসহ সাহিত্যের নানা শাখায় তিনি অসাধারণ দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে বিচরণ করেন। দুই বাংলার পাঠক ও বোদ্ধা মহলে আদৃত, নন্দিত তিনি।
প্রবীর বিকাশ সরকার জাপানে থাকেন তিন দশকের বেশি সময় ধরে। জাপানে বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে নীরবে প্রচার করে যাচ্ছেন তিনি। জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্ক অনুসন্ধান বিষয়ে তার অবদান উল্লেখযোগ্য। তিনি জাপানেও পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। দেশটির ইতিহাস, সংস্কৃতি, জাপান-রবীন্দ্রনাথ সম্পর্ক এবং এশিয়ার সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে বিস্তর গবেষণামূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ দুই বাংলার পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীতে লিখে আসছেন অনেক বছর ধরে।
প্রবীর বিকাশ সরকার এশিয়ার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমিতে জাপানের ঐতিহাসিক ভূমিকার ওপর জাপানি ভাষায় বই লিখেছেন। এর নাম ‘নিহোন গা আজিয়া অ মেজামে সাসেতা’ (জাপান এশিয়াকে জাগ্রত করেছে)। তিনি বর্তমানে দেশে অবস্থান করছেন। এই লেখক ফেব্রুয়ারিজুড়ে অনুষ্ঠেয় একুশের বইমেলা, এর আয়োজক বাংলা একাডেমি ও নিজের নতুন বই প্রসঙ্গে কথা বলেছেন সুখবর ডটকমের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুখবরের বিশেষ প্রতিবেদক।
প্রবীর বিকাশ সরকার বলেন, ‘একুশের বইমেলা হওয়া উচিত বেসরকারিভাবে, প্রকাশনা সংস্থাগুলোর উদ্যোগে। সরকারিভাবে বইমেলার আয়োজনের কোনো অর্থ আছে বলে আমি মনে করি না। এটা আমলাতান্ত্রিক সমাবেশ মাত্র। বৈচিত্র্যহীন, অকেজো। প্রতিবার বইমেলা উপলক্ষে একটি থিম থাকা উচিত। বইমেলাকে আন্তর্জাতিকায়ন করা জরুরি। বিদেশি বইয়ের সমারোহ থাকা প্রয়োজন নতুন প্রজন্মের জন্য। মেলা চলাকালে আয়োজিত সেমিনারগুলোতে বিদেশি কবি, সাহিত্যিক, গবেষকদের উপস্থিতিও কাম্য।’
তার মতে, ‘বাংলা একাডেমি বিদেশি সাহিত্যিক ও গবেষকদের আহবান করে না, কাজের মূল্যায়নস্বরূপ পুরস্কৃতও করে না। এটা একুশ শতকে চিন্তারও অতীত। এর মধ্য দিয়ে একাডেমি যে একটি পশ্চাৎপদ ও নিম্নমানের প্রতিষ্ঠান, সেটাই প্রমাণিত হয়।’
তিনি বলেন, ‘বাংলা একাডেমির উচিত একটি অনুবাদ অনুষদ প্রতিষ্ঠা করা। এই বিষয়ে আমি একাধিকবার বলেছি এবং লিখেছি। বাংলা সাহিত্যের অনুবাদও বহির্বিশ্বে প্রচার করা দরকার দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে। বাংলা একাডেমি একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল মাতৃভাষার উন্নয়ন এবং গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশ। এই সূত্র ধরে প্রবাসে যেসব বাংলাদেশি সুদীর্ঘকাল ধরে মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা, গ্রন্থপ্রকাশ এবং পত্রিকা প্রকাশ করে আসছেন, তাদের সেসব গ্রন্থ, প্রকাশনা ও কর্মকাণ্ডের ইতিহাস সংগ্রহ করা ও প্রদর্শন করা বাংলা একাডেমির দায়িত্ব ও কর্তব্য।’
তিনি বলেন, ‘এই বিষয়েও আমি অনেক লেখালেখি করেছি। এমনকি বাংলা একাডেমির প্রাক্তন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান জাপানে গেলে তাকেও অনুরোধ করেছিলাম ২০১০ সালে। তিনি কোনো প্রকার আগ্রহই দেখাননি। আমার সময় ও অর্থ দুই-ই বিফলে গিয়েছে।’
তিনি মনে করেন, ‘বাংলা একাডেমিকে স্বাধীনতার পর প্রতিটি সরকার নানাভাবে কলঙ্কিত করেছে, বিতর্কিত করেছে, বিপথে চালিত করেছে স্বেচ্ছাচারের সাথে। যা কাম্য ছিল না। রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক অপশাসনের প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে একাডেমিকে জনস্বার্থে একটি সত্যিকার একাডেমিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করাই শ্রেয়। যত দ্রুত সেটা হবে, ততই মঙ্গল।’
রবীন্দ্র গবেষক প্রবীর বিকাশ সরকার বলেন, ‘একাডেমির পুরস্কার নিয়েও অনেক বছর ধরে নিয়মনীতি লঙ্ঘন করা হচ্ছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক, জাতীয় লজ্জার। কীসের ভিত্তিতে, কোন মানদণ্ডে পুরস্কার প্রদান করা হয়, সেটা বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করতে হবে। জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে। পুরস্কার পরিষদের সদস্যদের নাম প্রকাশ করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘একাডেমির সভাপতির পদটি অনর্থক। এটা বাদ দেওয়া কমন সেন্সের ব্যাপার। মহাপরিচালক যথেষ্ট, সহকারি পরিচালক দুজন। মহাপরিচালক দুই বছর ও সহকারী পরিচালকও দুই বছরের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়া উচিত। নিয়ম অনুযায়ী সহকারী পরিচালক মহাপরিচালক হবেন। অনভিজ্ঞ লোক মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচায়ক। একাডেমির গবেষকদেরকে কোন মানদণ্ড এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়, তার প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। তিন বছরের বেশি গবেষক থাকতে পারবে না, এমন নিয়ম দরকার।’
তিনি আরো বলেন, ‘একাডেমির আজীবন সদস্যপদ একটি অহেতুক বিলাসী নিয়ম বা নীতি। এর কোনো প্রয়োজন নেই। বাৎসরিক সদস্য সমাবেশ বা সাধারণ সভার প্রয়োজন নেই, এটা যেহেতু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়। বেসরকারি হলে ভিন্ন নিয়মনীতি বিদ্যমান। বাংলা একাডেমির কর্মকর্তাদের তালিকা ও যোগ্যতার ইতিবৃত্ত প্রকাশ করা জরুরি। সর্বোপরি, পরিবেশ গড়ে তোলা জরুরি। পরিবেশ রুচিবোধের জননী।’
পাঠকদের উদ্দেশে প্রবীর বিকাশ সরকার বলেন, আসন্ন একুশের বইমেলায় তার নতুন দুটি বই আসছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, ‘জানা অজানা জাপান’ (প্রবন্ধ সংকলন, পঞ্চম খণ্ড, অনুপ্রাণন প্রকাশন); অন্যটি হচ্ছে, ‘সূর্যোদয়ের দেশে সত্যজিৎ রায়’ (বর্ধিত সংস্করণ, এন আর বি স্কলার্স পাবলিশার্স)।
শান্তনু/ আই.কে.জে/
খবরটি শেয়ার করুন