প্রতীকী ছবি (সংগৃহীত)
রবিউল হক
ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের ইতিহাস তিন হাজার বছরেরও বেশি। এ অঞ্চল নানা সময় নানা জাতি দ্বারা শাসিত হয়েছে। যার কারণ হলো ধর্মীয় অদূরদর্শিতা ও সাম্প্রদায়িকতা। ধর্মীয় অন্ধ অনুশাসন মানবিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ধর্মীয় নেতাদের বিশেষ সুবিধায় প্রবর্তিত এক চাপিয়ে দেয়া কাঠামোবাদ প্রতিষ্ঠা করে। উন্মুক্ত শান্তির দুয়ার বার বার বন্ধ হয়ে গেছে প্রতিনিয়ত- ঘৃণ্য হত্যা ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবের কারণে। এর ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে যত মতাদর্শের সৃষ্টি হয়েছে-তার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল নৈতিকতা ও মানবিকতা। যে কোনও ধর্মই মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠায় সৃষ্ট, কিন্তু বিকাশের পর ধীরে ধীরে তা গোঁড়ামিতে ধাবিত হতে হতে মানববিদ্বেষী প্রবণতায় নিমগ্ন হয়। এদেশ যেমন কখনোই সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত ছিল না, একইভাবে মানবতাবাদের জয়গান গীত হয়েছে। এখানে ধর্ম ও জাতি নিয়ে যেমন নগ্ন চর্চা হয়েছে, আবার প্রতিবাদী লৌকিক ধারাও তাদের প্রতিহত করেছে। বাউল কবি পাঞ্জু সাঁই-এর একটি গানে উল্লেখ আছে-
‘জাতির বড়াই কি ইহকাল জাতি করে কি
আমার মন বলে অগ্নি জ্বেলে দিই জাতির মুখি’।
দুদ্দু শাহ আরো বলেছেন-
‘জাতি ধর্মের বড়াই করো না ভাই
কত শত মহাপুরুষ তাদের ঠিকানা তো নাই।
ধলা কালার একই বীজ ভাই, সর্ব জাতি জাতেম হয় উদয়,
কর্মগুণে এই সমাজে, ভিন্ন গোত্র আখ্যা পাই’।।
ফকির লালন সাঁইয়ের গানে আছে-
‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন কয়, জাতের কি রূপ,
দেখলাম না এই নজরে।।
কেউ মালা, কেউ তসবি গলায়
তাই তে কি জাত ভিন্ন বলায়
যাওয়া কিংবা আসার বেলায়
জাতের চিহ্ন রয় কার রে’।।
১৯২৪ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছর ভারতীয় উপমহাদেশের কোনও না কোনও স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। ফলে স্বদেশী আন্দোলনের কালে কবি, লেখক ও শিল্পীগণ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ব্যাপক সোচ্চার ছিলেন। কাজী নজরুল ইসলামের একটি গানে বলা হয়েছে-
‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াত খেলছে জুয়া
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া।
হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি, ভাবলি এতেই জাতির জান,
তাই ত বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে একশ’খান।
এখন দেখিস ভারত-জোড়া
প’চে আছিস বাসি মড়া,
মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত শেয়ালের হুক্কাহুয়া’।।
আরো পড়ুন : কবিতা : স্মৃতিচারণ-২ —শুভ্র হীম
তিনি আরো বলেছেন-
‘মোরা একই বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু মুসলমান
মুসলিম তার নয়নমণি হিন্দু তাহার প্রাণ’।
১৯৪১ সালে হোলি উৎসবকে কেন্দ্র করে ঢাকায় ভয়ানক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। যার প্রভাব নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ময়মনসিংহসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কবিয়াল নিবারণ পণ্ডিত রচনা করেন-
‘হরি তোমার অপার লীলা বোঝা হল ভার
শুনতে পাই ঢাকা শ’রে, মানুষে মানুষ মারে
ঘর পোড়ায় দিন দুপুরে, করে নানা অত্যাচার
যে যাহারে পোড়ায় যেথায় পায়, ছুরিকাঘাত করে গায়
পিছন থেকে মারে মাথায়, নাই তার কোন প্রতিকার’।।
তথ্যসূত্র
১. বাংলাদেশের গণসংগীত: বিষয় ও সুরবৈচিত্র্য, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০৯
২. আমজাত হোসেন, বাংলাদেশের কৃষক আন্দোলনের গান, (১ম খণ্ড), পড়ুয়া, ঢাকা, ২০০৩
৩. আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, খোশরোজ কিতাব মহল, ঢাকা, ১৯৯৫
এস/ আই.কে.জে/