সংবিধান সংস্কার ও আসন্ন নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক বিভাজন ও অনিশ্চয়তা নিয়ে আলোচনা করেছেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাসুদ কামাল। তিনি বলেছেন, নির্বাচনের তারিখ ঠিক হলেও জনগণের মনে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে আদৌ নির্বাচন হবে কি না। এই সন্দেহের মূল কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত সংস্কার প্রক্রিয়ার বিতর্ক এবং ‘জুলাই সনদ’ ঘিরে বিএনপির আপত্তি।
তার মতে, অনির্বাচিত বিদেশফেরত ব্যক্তিদের নেতৃত্বে সংবিধান সংস্কারের চেষ্টা দেশ ও সংবিধান উভয়ের জন্যই অস্বস্তিকর। বিএনপির আপত্তি শুধু তাদের একক অবস্থান নয়—তাদের মতো বৃহৎ রাজনৈতিক দলের আপত্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বড় আপত্তিতে পরিণত হয়। তিনি বলেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বাইরে কেউ সংবিধান সংশোধন করতে পারে না—এটি ইতিহাস, গণতন্ত্র এবং মুক্তিযুদ্ধের ধারার বিপরীত।
গতকাল বুধবার (২০শে আগস্ট) নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল ‘কথা’তে প্রচারিত ভিডিও আলোচনায় তিনি এসব মন্তব্য করেন। আজ বৃহস্পতিবার (২১শে আগস্ট) বেলা আড়াইটা পর্যন্ত ভিডিওটি প্রায় ৩৯ হাজার বার দেখা হয়েছে।
আলোচনায় মাসুদ কামাল বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরেই আমি বলে আসছিলাম, নির্বাচনের সময় প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গেছে—ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে, এবং সেটি প্রধান উপদেষ্টা নিজেই ঘোষণা করেছেন। নির্বাচন কমিশনও তার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এগুলো ইতিবাচক হলেও মানুষ এখনো সন্দেহে আছে, নির্বাচন হবে কি না—এই প্রশ্নটা বারবার উঠে আসছে।’
এই অনিশ্চয়তার পেছনে মূল কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছেন, নির্বাচনের আগে একটি ‘সংস্কার’ দরকার। এই সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে, সেটা প্রথমে কমিশনের মাধ্যমে, পরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের ব্যানারে হয়েছে। অনেকে একমত হয়েছে, অনেকে হয়নি। এরপর জুলাই সনদ তৈরির সময় নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি এই সনদ নিয়ে আপত্তি তুলছে। তারা বলছে, এটি একটি রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল, কিন্তু এটি সংবিধানের ওপর স্থান পেতে পারে না। অন্যদিকে যারা সনদ তৈরির কাজ করেছে, তারা বলছে—এই দলিলই সব কিছুর ভিত্তি হবে এবং এটি নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। বিএনপি এই অবস্থান মানতে পারছে না।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদের বক্তব্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘তিনি প্রশ্ন তুলেছেন—৭২-এর সংবিধান কি শুধুই আওয়ামী লীগের? তিনি বলেন, এটি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সশস্ত্র বিপ্লবের ফসল, এবং দেশের সব রাজনৈতিক দলই এই সংবিধান সংশোধন করেছে। এখনো সংশোধনের সুযোগ আছে, তাহলে কেন এটি ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে?’
তিনি আরও বলেন, ‘সংবিধান বাতিল করতে চাচ্ছেন কেউ কেউ—যেমন আলী রিয়াজ। কিন্তু হাফিজ উদ্দিন বলছেন, এটা আমরা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পেয়েছি, বহুবার সংশোধিত হয়ে আজকের রূপ নিয়েছে, এটা বাদ দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।’
মাসুদ কামাল প্রশ্ন তোলেন, ‘ড. আলী রিয়াজ কেন বাংলাদেশের সংবিধান বদলাতে চান? তিনি তো এই দেশের ১৭ বছরের সংগ্রামে ছিলেন না, ছিলেন না ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে, কিংবা জুলাই-আগস্ট বিপ্লবেও অংশ নেননি। তাহলে কেন তারা সংবিধানকে ছুঁড়ে ফেলতে চাইছেন? কিছু এনজিও, কিছু অল্প বয়সী রাজনৈতিক অযোগ্য লোকজন কিছু বললেই সেটা মানতে হবে?’
তিনি বলেন, ‘সারা পৃথিবীতে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই সংবিধান সংশোধন করে। অথচ বাংলাদেশে কিছু অনির্বাচিত ব্যক্তি, যারা বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন, তারা এখন সংবিধান পরিবর্তনের কথা বলছেন—এটা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন।’
হাফিজ উদ্দিন আহমেদ-এর বক্তব্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদে বলা হয়েছে—তাতে স্বাক্ষরের মাধ্যমেই বর্তমান সংবিধান বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু জাতীয় সংসদের বাইরে কেউ কীভাবে সংবিধান সংশোধনের অধিকার পায়? এটা সংবিধানবিরোধী।’
মাসুদ কামাল তার বক্তব্যে বলেন, ‘ড. আলী রিয়াজের নেতৃত্বে যে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছিল, আমি সেই সময় থেকেই বলে আসছি, এটি কিছুই হবে না। এটা হওয়ার কথা না। এতদিন ধরে এই প্রক্রিয়া চালিয়ে এখন যদি বিএনপি সই না করে, তাহলে এই প্রচেষ্টা কী কাজে এল?’
তিনি ব্যঙ্গাত্মকভাবে মন্তব্য করেন, ‘তিন মাসে যদি নির্বাচন দেওয়ার সাহস থাকত, তাহলে এতদিন এই প্রক্রিয়াগুলো চালিয়ে সময় নষ্ট করার প্রয়োজন ছিল না। পোলাপানদের ক্ষমতায় এনে ধান্দাবাজি, অর্থ আত্মসাৎ—এসব শুনতে হতো না। এখন দেশের ভবিষ্যৎ কোথায় যাচ্ছে কেউ জানে না।’
তিনি শেষ করেন এভাবে—‘সবকিছু স্মুথলি হয়ে যাবে এমন সম্ভাবনা আমি দেখছি না। ‘জুলাই সনদ’-এ বিএনপি যদি সই না করে, তাহলে সংস্কারটা কোথায় যাবে?’
খবরটি শেয়ার করুন