বাংলাদেশের রাজনীতি এক দীর্ঘ অনিশ্চয়তার পথে দাঁড়িয়ে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জনগণের মনে প্রশ্ন, বিভ্রান্তি ও ভয়ের মেঘ জমে উঠেছে। এরই প্রেক্ষাপটে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও তৃতীয় মাত্রার উপস্থাপক জিল্লুর রহমান শনিবার (১৬ই আগস্ট) তার নিজস্ব ইউটিউব প্ল্যাটফর্মে গুরুত্বপূর্ণ ভিডিও বার্তা দিয়েছেন, যেখানে তিনি সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন—‘আসলে নির্বাচন হবে তো?’
ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত ভিডিওটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। আজ সোমবার (১৮ আগস্ট) দুপুর পৌনে ৩টা পর্যন্ত ৮৭ হাজার ৫০০—এর বেশি ভিউ হয়েছে। ভিডিওতে তিনি নির্বাচন, প্রশাসন, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী, তরুণ রাজনীতিক, সংবিধান সংস্কার প্রক্রিয়া, নির্বাচনী প্রতীক, এবং বিশেষ উপদেষ্টাদের ভূমিকা নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন।
‘ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না’— কঠোর বার্তা
জিল্লুর রহমানের বক্তব্যের মূল নির্যাস হলো—‘আমি নির্বাচন চাই, কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না। আর হলেও সেটা কোনো প্রকৃত নির্বাচন হবে না।’ তিনি বলেন, যারা দ্রুত নির্বাচনের কথা বলছেন, তিনিও তাদের একজন। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। তার মতে, নির্বাচন বিলম্বিত করার একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক কৌশল বর্তমানে সক্রিয়। তিনি ‘সিজিএস’ আয়োজিত ‘পলিটিক্স ল্যাব’ কর্মসূচির অভিজ্ঞতা থেকে জানান, দেশের তরুণ ছাত্রনেতারাও বিশ্বাস করেন না যে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে।
নির্বাচন বিলম্বিত করার কৌশল ও অজুহাত
জিল্লুর রহমান মনে করেন, নির্বাচনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কিছু বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও সরকারের অভ্যন্তরে সক্রিয় ‘দাপুটে অংশ’। তারা গণতন্ত্রের নামে দাবি তুলছে—
• সংবিধান সংস্কার পরিষদ
• পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন
• স্থানীয় সরকার ও ছাত্র সংসদ নির্বাচন
• জুলাই সনদের বাস্তবায়ন
• এক্সিকিউটিভ আদেশে সংস্কার
এই দাবি-দাওয়া একদিকে সংস্কারের মোড়কে নির্বাচন বিলম্বের অজুহাত তৈরি করছে। অন্যদিকে, এতে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরানোর প্রয়াসও আছে বলে তিনি ইঙ্গিত দেন।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও প্রশাসনিক অভ্যুত্থানের শঙ্কা
জিল্লুর রহমান বলেন, বর্তমানের একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী এখন নির্বাচন চায় না। কারণ তারা মনে করে, ‘এই সময়টাই তাদের জন্য মোক্ষম সময়—প্রশাসনে লোক ঢোকানো, ব্যবসা গুছানো এবং ভবিষ্যতের জন্য শক্ত ঘাঁটি তৈরি করার।’ তিনি আরও বলেন, এরা হয়তো আগামীতে কোনো প্রশাসনিক বা ‘নরম অভ্যুত্থান’-এর দিকে এগোতে চায়, কারণ জানে—জনগণের রায় কখনোই তাদের পক্ষে যাবে না।
নির্বাচনী প্রতীক ও ভোটার বিভ্রান্তির বাস্তবতা
বাংলাদেশের ভোটার এখনো প্রতীক দেখে ভোট দেন—নৌকা, ধানের শীষ, লাঙ্গল, দাঁড়িপাল্লা। তার মতে, রাজনৈতিক অঙ্কে যদি কোনো পরিচিত দলের প্রার্থীকে অপরিচিত প্রতীকে দাঁড় করানো হয়, তাহলে ভোটার বিভ্রান্ত হবে এবং প্রকৃত সমর্থনের প্রতিফলন ঘটবে না।
‘আপনি দলীয় আদর্শে বিশ্বাসী একজন নেতাকে বাদ দিয়ে তার প্রতীক ছাড়া ভোটে দাঁড়ান—এটা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা।’ তিনি বলেন, এতে প্রকৃত রাজনৈতিক চর্চার বদলে কৌশলগত প্রহসন হবে।
উপদেষ্টাকে কেন্দ্র করে বিস্ফোরক অভিযোগ
জিল্লুর রহমান একজন ‘বিশেষ উপদেষ্টা’-র বিষয়ে তীব্র সমালোচনা করেন, যার বিরুদ্ধে রয়েছে—
• অস্ত্রের লাইসেন্স থাকা সত্ত্বেও বিমানবন্দরে ম্যাগাজিন বহনের চেষ্টা
• রাত-বিরাতে বিলাসবহুল এলাকায় যাতায়াত
• দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ
• নির্বাচন সামনে রেখে পদত্যাগের নাটক
• মাস্ক পরে এনসিপির বৈঠকে অংশগ্রহণ
‘একদিকে তিনি বলছেন নিরাপত্তা দরকার, আবার গভীর রাতে হাঁসের মাংস খেতে বের হন। এতে কি বোঝা যায়?’ এই মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি প্রশাসনিক নিরাপত্তার জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
সরকার কি নিরপেক্ষ ও নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত?
জিল্লুর রহমান স্পষ্টভাবে বলেন—‘এই সরকার নিরপেক্ষ নয়, নির্বাচন আয়োজনের সক্ষমতাও নেই।’ তিনি যুক্ত করেন, নির্বাচন কমিশন এখনো ভাসমান নীতিতে চলছে এবং নানা সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখে নির্বাচন? বিপজ্জনক ধারণা
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ছিল—‘আওয়ামী লীগকে নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে বাদ দিলে দেশে ভয়াবহ অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।’ তিনি বলেন, অপরাধের বিচার হোক, কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচন চালানো অসম্ভব ও বিপজ্জনক। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন পরবর্তী বিশৃঙ্খলা অনিবার্য হতে পারে।
তিনি বলেন—‘যে নির্বাচন মানুষের অধিকার নিশ্চিত করবে, সেটা হবে না। হবে একটা ভাগাভাগির ‘চুক্তিনির্ভর’ নির্বাচন।’ তার দৃষ্টিতে এ নির্বাচন হবে এমন একটি খেলা যেখানে রাজনৈতিক শক্তিগুলো ক্ষমতা ভাগাভাগি করে কিন্তু জনগণের অধিকার বাস্তবে কোনো প্রতিফলন পাবে না।
খবরটি শেয়ার করুন