রবিবার, ৩রা আগস্ট ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৯শে শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ

*** এনসিপির ‘নতুন বাংলাদেশের ইশতেহার’ ঘোষণা *** তিন দশকের রাজনীতিতে আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন দুই শক্তিশালী নারী: মাহফুজ আনাম *** সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলবে ঐকমত্য কমিশন *** তারুণ্যের প্রথম ভোট ধানের শীষের জন্য হোক: তারেক রহমান *** গঙ্গাচড়ায় হিন্দুপল্লিতে হামলাকারীদের উসকানি, স্থানীয় সাংবাদিক গ্রেপ্তার *** যাত্রীর লাগেজটি নড়ছিল, খুলতেই ভেতরে ২ বছরের শিশু *** তারেক রহমান আসবেন, আমাদের নেতৃত্ব দেবেন, পথ দেখাবেন: মির্জা ফখরুল *** ১৮ তলা থেকে পড়ে বেঁচে গেল তিন বছরের শিশু *** ট্রাম্পের হুমকিতেও রাশিয়ার তেল কেনা অব্যাহত রাখবে ভারত *** নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর নির্বাচনী পর্ষদ উদ্বোধন করলেন প্রধান উপদেষ্টা

বাংলার ভাগ্য, বাঙালির আশা এবং আমেরিকার লবিস্টদের কথা

অরুণ কুমার গোস্বামী

🕒 প্রকাশ: ০১:১৩ অপরাহ্ন, ১০ই জুন ২০২৩

#

প্রফেসর ড. অরুণ কুমার গোস্বামী

বাংলার ভাগ্য এবং বাঙালির আশা আদৌ কি আমেরিকার লবিস্টদের উপর নির্ভর করে? আমরা যদি একদিকে ‘বাংলার ভাগ্য ও বাঙালির আশা’ বিষয়টিকে রাখি এবং অপরদিকে বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘লবিস্ট’দের রাখি তাহলে বাংলাদেশের মানুষের কাছে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে? এই প্রশ্নের সম্মুখীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মকালে হতে হয়েছিল এবং সেই একই প্রশ্ন স্বাধীনতার ৫২ বছর পরে এখনও দেখা দিচ্ছে। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরকারিভাবে যুক্তরাষ্ট্র সর্বশক্তি নিয়ে বিরোধিতা করেছিল। মার্কিনিদের অবস্থান ছিল তখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পক্ষে। শুধু মার্কিনিরা নয়, চীন এবং সৌদি আরবও তখন পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। এইসব পরাশক্তির বিরোধিতা সত্ত্বেও রক্তের সাগর পেরিয়ে স্বাধীনতার সোনালী সূর্য বাঙালিরা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। বাঙালিদের স্বাধীনতার এই মরণপন যুদ্ধে অপরিহার্যভাবেই ঐতিহাসিক নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর বর্তমানের কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যায় যে ‘বাংলার ভাগ্য এবং বাঙালির আশা’ মূলত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। 

দৃশ্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশে তাদের অবস্থান শক্ত-পোক্ত করে তোলার জন্য তাদের বাংলাদেশী রাজনৈতিক দোসরদের পক্ষে সর্বশক্তি দিয়ে নেমে পড়েছে। বলা যায়,  ‘তেড়ে ফুঁড়ে’ নেমে পড়েছে। অন্তত দেশের প্রথম সামরিক শাসক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক-হানাদার বাহিনীর সহযোগী রাজাকার, আল বদর, আল শাম্স এবং পিস কমিটির সংগঠনের মাধ্যমে গণহত্যা ও মানবতা বিরোধী অপরাধের সংগঠক জামায়াতে ইসলামের আমেরিকার লবিং সংশ্লিষ্টতা দেখে তাই মনে হচ্ছে। 

প্রসঙ্গক্রমে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে লেখা ছয় জন কংগ্রেসম্যানের চিঠির বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। রাজনৈতিক কর্মকান্ড এবং সংশ্লিষ্টতা থেকে বোঝা যায় যে চিঠিতে স্বাক্ষরকারীরা রিপাবলিকান দলের ডানপন্থী মতাদর্শী। স্কট পেরি ফ্রিডম ককাসের চেয়ারম্যান। ক্যাপিটল হিল হামলায় প্রাক্তন সামরিক বাহিনীর সদস্য এই কংগ্রেসম্যানের ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি ২০২০ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচন কারসাজি তথা উল্টানোর প্রক্রিয়াতেও জড়িত ছিলেন । মজার বিষয় হলো, কংগ্রেসম্যান পেরি ২০২১ সালে মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের নিন্দা বিলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন।

কংগ্রেসম্যান বব গুড একজন রক্ষণশীল রাজনীতিবিদ হিসেবেও পরিচিত যিনি অনেক সামাজিক সমস্যা এবং  যুক্তরাষ্ট্রে স্বীকৃত অধিকারের বিরুদ্ধে। কংগ্রেসম্যান গুড কোভিড-১৯ মহামারীকে ‘নকল মহামারী' হিসাবে আখ্যায়িত করেন । এছাড়া তিনি অনেক অধিকার আন্দোলনের বিরুদ্ধে। 

আরেকজন স্বাক্ষরকারী, ব্যারি মুর একজন কট্টর রিপাবলিকান। তিনিও পেরির মতো মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের নিন্দা বিলের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। মিস্টার মুর-এর একটি শক্তিশালী বন্দুক লবি আছে। তিনি এআর -১৫ কে 'জাতীয় বন্দুক' করার জন্য কংগ্রেসে একটি বিল উত্থাপন করেন । এআর-১৫ মার্কিন গণ শুটিংয়ের  সবচেয়ে বিপজ্জনক অস্ত্র। এআর এর পূর্ণ আকার হচ্ছে আর্মালাইট রাইফেল। এটিকে কোনও কোনও সময় অ্যাসল্ট রাইফেল বা আমেরিকার রাইফেল হিসাবেও বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এআর-১৫ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক সংস্কৃতির প্রতীক: বন্দুক উৎসাহীরা এটির বহুমুখীতা এবং শক্তির জন্য এটিকে প্রচার করে, যেখানে বন্দুক নিয়ন্ত্রণের সমর্থকরা পাবলিক স্থানে অনেকগুলি গুলিবর্ষণের ক্ষেত্রে এআর-১৫এর ভূমিকাকে ঘৃণা করে।

চিঠির অন্যান্য স্বাক্ষরকারী, ওয়ারেন ডেভিডসনও ফ্রিডম ককাসের একজন সদস্য এবং কিথ সেলফ এবং টিম বার্চেটও অধিকার প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত নন।

তাই, এই ধরনের কট্টরপন্থীদের পক্ষে বাংলাদেশে মানবাধিকার নিয়ে গবেষণা করা এবং তাদের অভ্যন্তরীণ অধিকারের দিকগুলিকে উপেক্ষা করে এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে রক্ষণশীলতার অনুশীলন করার সময় হঠাৎ করে অধিকার প্রবক্তা হিসাবে আবির্ভূত হওয়া কিছুটা অস্বাভাবিক। 

 ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশে পরিণত হয়েছে। সে কারণে ছয় কংগ্রেসম্যানের চিঠি মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিতে দ্বিপক্ষীয় ঐকমত্য অনুযায়ী হতে পারে। চিঠিটি বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য লিখিত এ ধারণাটি যৌক্তিক। অন্যদিকে, এটা হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো বিশেষত বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী-এর লবিংয়ের ফসল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লবিং একটি আইনি প্ররোচনা প্রক্রিয়া কিন্তু বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক জায়গায় এটি অবৈধ বলে বিবেচিত হয়। ২০১৮ সালের পলিটিকো রিপোর্ট অনুসারে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির পক্ষে লবিং করার জন্য আব্দুল সাত্তার নামে দলের একজন সদস্যের মাধ্যমে দুটি কোম্পানি- ব্লু স্টার স্ট্র্যাটেজিস এবং রাস্কি পার্টনারস নিয়োগ করেছে।

ব্লু-স্টারের সাথে চুক্তির মূল্য ছিল আগস্ট মাসে ২০,০০০ ডলার এবং ২০১৮ সালের অবশিষ্ট মাসগুলোর জন্য প্রতি মাসে ৩৫,০০০ ডলার । রাস্কি পার্টনারস ব্লু-স্টারের একটি সাব-কন্ট্রাক্টর হিসাবে কাজ করত এবং আগস্ট মাসে ১০,০০০ ডলার এবং মাসে ১৫,০০০ ডলার মূল্যের পেমেন্ট পাবে  বছরের বাকি সময়।

এত এত ডলার খরচ করে লবিং সৃষ্টি করার পরেও বিএনপি-জামায়াত এর মার্কিন লবি বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত স্যাংশন পাচ্ছে না।  

পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের ভূগোলের গন্ডি পেরিয়ে মার্কিন মূলুকসহ বিশ্ব রাজনীতির নেতৃত্বদানকারী শক্তিশালী সব রাষ্ট্র ও নন-স্টেট অ্যাক্টরদের আলোচনার টেবিলে এখন বাংলার ভাগ্য ও বাঙালির আশা-নিরাশার বিষয়গুলো ঝুলিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা ‘আর আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না. . .!’ বিশ্বের যে স্থানে বসে যে যাই কিছু করুক না কেন, আমাদের জাতির পিতা আমাদের এই অবিনাশী মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছেন। এটাই আপাতত বাঙালিদের শেষ এবং প্রধান আপ্ত বাক্য। আত্মবিশ্বাস ও আত্মশক্তির উৎস। 

বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথ অনুসারণ করেই প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দৃঢ়ভাবে বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণ কখনোই কোনো বিদেশি চাপের কাছে মাথা নত করবে না। তিনি ০৭ জুন ২০২৩ ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় সভাপতির ভাষণে বলেন, ‘দেশি-বিদেশি চাপ যতই আসুক না কেন, বাঙালিরা কখনোই সেই চাপের কাছে মাথা নত করবে না।’ 

বিশ্বের ৮০টি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ৭৫০টি সামরিক ঘাঁটি আছে। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে যুক্তরাজ্যের আছে ১৪৫টি সামরিক ঘাঁটি। অপর দিকে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে রাশিয়ার আছে তিন ডজন সামরিক ঘাঁটি। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত সবাই ইউক্রেন আক্রমণের জন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। কিন্তু তা সফল হয় নাই। অপর দিকে আমেরিকার বন্ধু পাকিস্তানের অবস্থা এখন ত্রাহী ত্রাহী। আবার সোভিয়েত ইউনিয়নকে তাড়িয়ে আফগানিস্তান দখলের পর সেই আফগানিস্তান ছেড়ে আমেরিকাকে চলে যেতে হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে একরকম অসহায় অবস্থার মধ্যে নিপতিত হয় আফগানিস্তানে আমেরিকার হয়ে যারা কাজ করেছে তাদের। আমেরিকার সৈন্য চলে যাওয়ার পর আমেরিকার পক্ষে যারা কাজ করেছে তেমন অনেককে তালেবানেরা হত্যা করেছে।

এখন বাংলাদেশে যারা আমেরিকার ছয় কংগ্রেসম্যান এবং আমেরিকার স্যাংশনের ভরসায় দৌঁড় ঝাপ করছেন তাদের উচিত পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানে আমেরিকার মিত্রদের পরিস্থিতির দিকে নজর দেয়া! আমেরিকার উপর ভরসা স্থাপনকারী বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের বিশেষত বিএনপি-জামায়াত নেতাদের উচিত আমেরিকার বন্ধু রাষ্ট্র পাকিস্তান এবং তালেবান শাসিত আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার সৈন্য চলে যাওয়ার পরের পরিস্থিতির প্রতি মনোযোগের সাথে লক্ষ্য করা। তাদের পেয়ারে পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের মার্কিন লবিস্টদের অনেক কিছু শেখার আছে। 

“বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রীষ্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালী।” এই গানটি জাগরণের গান হিসাবে খ্যাত। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজনে এই কথাগুলো দিয়ে চালানো যায়। এই লাইনকে বাঙালির আশার ভিত্তিভূমি হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। বাংলা সঙ্গীত জগতের মৌলিক গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার-এর লেখা গানের শুরুতেই  এখানে চার ধর্মাবলম্বী মানুষের কথা বলা হয়েছে, যাদের সমন্বয়ে ‘বাঙালি’ নামক জাতীয়তার পরিচিতি গড়ে উঠেছে। বাংলা এবং বাঙালি যাদের চিন্তাধারায় প্রবাহমান তারা এটা স্বীকার করবেন যে বাংলা এবং বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান অথবা সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম যাদের চেতনায় সদা জাগ্রত। 

অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী, লেখক ও গবেষক। পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ঢাকা।





Important Urgent

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন