ছবি: সংগৃহীত
রংপুরের গঙ্গাচড়ার বেদগাড়ি ইউনিয়নের আলদাদপুর বালাপাড়ায় ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগ তুলে ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালানো হয়। ফেসবুকের পোস্টে ইসলাম ধর্মের প্রচারক মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে এক কিশোর অবমাননাকর লেখা ও ছবি শেয়ার করেছে, এমন অভিযোগ তুলে গঙ্গাচড়ায় হিন্দুপল্লিতে হামলা করা হয়েছে। ১৭ বছর বয়সী অভিযুক্ত ওই কিশোর একটি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের তৃতীয় পর্বের শিক্ষার্থী।
অভিযোগ শোনার পর ওই কিশোরের পরিবার থেকেই তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরও একদল উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তি তার বিচারের দাবিতে মিছিলসহ তার বাড়ির সামনে যায়। বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করে। পরে থানা পুলিশ ও সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এটা ছিল প্রথম দফায় ভাংচুর।
পরদিন সেসব ব্যক্তি মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করে এক পর্যায়ে যখন আসে, তখন তো পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউই ছিল না। কেন, ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করার সময় প্রশাসন নিস্ক্রিয় ছিল, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
বসবাসের ঘরগুলো ভাংচুরের পর ধারালো অস্ত্র দিয়ে ঘরের টিনগুলোও কেটে টুকরো টুকরো করেছে। ঘরে থাকা টাকা, সোনার অলঙ্কার ছাড়াও চাল-ডাল নিয়ে গেছে। গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি কিছুই বাদ যায়নি। পরিবারগুলোকে নিঃস্ব করে দেওয়া হয়।
দেশে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে এমন হামলার ঘটনা নতুন নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ‘নির্লিপ্ততার’ কারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনা বেড়েছে। অভিযোগের পর সংঘবদ্ধ হামলার ঘটনা ঘটছে। এমনকি প্রশাসনের উপস্থিতিতেও ঘটেছে হামলার ঘটনা।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে খুলনায় উৎসব মণ্ডল নামের ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরের বিরুদ্ধে মহানবী (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ ওঠে। খুলনা মেট্রোপিলটন পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের দপ্তরে নেওয়া হলে পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনীর উপস্থিতিতেই তাকে গণপিটুনি দেওয়া হয়। মারা গেছে মনে করে ফেলে গেলে পরে অবশ্য জানা যায় উৎসব বেঁচে আছে।
গত বছরের অক্টোবরে ফরিদপুরে ফেসবুকের এক স্ট্যাটাসের জন্য দ্বিতীয়বার ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তোলা হয় হৃদয় পাল নামের এক যুবকের বিরুদ্ধে। যে ফেসবুক আইডির কথা বলা হয়, সেটি হৃদয়ের আইডি, সেটা নিশ্চিত না হওয়া গেলেও তার উপর বারবার হামলা করা হয়েছে।
গত ডিসেম্বরে সুনামগঞ্জে এক হিন্দু তরুণের বিরুদ্ধে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ওঠে। সেই অভিযোগে সুনামগঞ্জের দুয়ারাবাজার ও মংলারগাঁওয়ে চলে ব্যাপক হামলা ও লুটপাট। হামলার পর ওই এলাকার বেশ কিছু হিন্দু পরিবার ভয়ে এলাকা ছেড়ে গেছে।
লালমনিরহাটে গত ২২শে জুন ধর্ম অবমাননার অভিযোগে নরসুন্দর পরেশ চন্দ্র শীল ও তার ছেলে বিষ্ণু চন্দ্র শীলকে মারধর করে পুলিশে দেওয়া হয়। প্রকাশ্যে অভিযুক্তদের ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ফাঁসি নিশ্চিত’ করার আশ্বাস দেন সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। অথচ বিবিসির প্রতিবেদনে উঠে আসে, ১০ টাকা কম দেওয়ার কথা-কাটাকাটির কারণে মিথ্যা অভিযোগে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ আনা হয়।
দেশে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ উঠলে কেন বারবার এমন হামলার ঘটনা ঘটে? আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন যথাযথ সময়ে সংখ্যালঘুদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না? সেসব প্রশ্ন বারবার আসছে। রাষ্ট্র এটা বন্ধ করতে চায় কী না, সেটাই আসল প্রশ্ন। কারণ, বারবার এসব কাজ করে তারা পার পেয়ে যাচ্ছে। যার ফলে দুষ্কৃতকারীরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে।
এসব বন্ধে দেশে রাজনৈতিক মতৈক্য দরকার, কিন্তু সেটা কখনো তৈরি হয়নি। বরং রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে দায় চাপিয়ে দিয়ে থাকে। যার ফলে যখনই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখনই একদল উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনার অযুহাত তৈরি করে।
খবরটি শেয়ার করুন