ছবি: সংগৃহীত
গণমাধ্যমকর্মী স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের আত্মহত্যার ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের বিচার দাবিতে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ২৪৩ বিশিষ্ট নাগরিক। আজ মঙ্গলবার (২১শে অক্টোবর) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা এবং কবি ও সাংবাদিক গিরীশ গৈরিকের পাঠানো এক বিবৃতির মাধ্যমে এ দাবি জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানতে পেরেছি যে, অনলাইন নিউজপোর্টাল ‘ঢাকা স্ট্রিম’–এর গ্রাফিক ডিজাইনার স্বর্ণময়ী বিশ্বাস (২৮) আত্মহত্যা করেছেন। সম্ভাবনাময় এক তরুণ সংবাদমাধ্যমকর্মীর অকাল, অনাকাঙ্ক্ষিত ও মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় আমরা গভীরভাবে শোকাহত, ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি।’
এতে বলা হয়, ‘বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুসারে, ঢাকা স্ট্রিমের বাংলা কনটেন্ট এডিটর আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি, অশোভন আচরণ ও মানসিক নিপীড়নের অভিযোগ এনে প্রতিষ্ঠানটির মানবসম্পদ বিভাগে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন স্বর্ণময়ী বিশ্বাসসহ ২৬ সহকর্মী।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘তারা আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে ৮টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করেন, যা স্পষ্টতই গুরুতর অন্যায় এবং নারীর প্রতি চরম অবমাননাকর আচরণ। অভিযোগকারীদের মধ্যে ৯ জন নারী সাংবাদিক ছিলেন, যারা প্রত্যেকেই অভিযুক্ত ব্যক্তির আচরণের কারণে হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘প্রতিষ্ঠানটির ২৬ সংবাদমাধ্যমকর্মীর লিখিত ও প্রমাণসাপেক্ষ অভিযোগের পরও ঢাকা স্ট্রিমের প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক গোলাম ইফতেখার মাহমুদ অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেননি। নিয়ম অনুযায়ী, এ ধরনের ঘটনায় অভিযুক্তকে সাময়িক বরখাস্ত করার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি তা করেনি; বরং তাকে দায়িত্বে বহাল রাখা হয়। আমরা মনে করি, এ ঘটনায় সংবাদমাধ্যমটির সম্পাদক-প্রকাশক এবং মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান তাদের নৈতিক ও প্রশাসনিক দায় এড়াতে পারেন না।’
বিবৃতিতে তারা আরও উল্লেখ করেছেন, ‘উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন ও অভিযোগ তদন্তের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ ঘটনায় সেই নির্দেশনা মানা হয়নি, যা আইন ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সহকর্মীদের ভাষ্যমতে, বিচার না পেয়ে স্বর্ণময়ী বিশ্বাস মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন, হতাশা ও বিষণ্ণতায় নিমজ্জিত হয়েছিলেন।’
বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এ ঘটনা শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের নয়, এটি বাংলাদেশের নারীকর্মীদের কর্মপরিবেশের ভয়াবহ বাস্তবতাকে প্রকাশ করে। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের মতো অপরাধ ঘটেই চলেছে; কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার সঠিক বিচার হচ্ছে না। ফলে অসংখ্য নারী নীরবে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন, কেউ কেউ বাধ্য হয়ে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন, কেউ আবার অপমান ও হতাশা সইতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন।’
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘আমরা মনে করি, স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের মৃত্যু দেশের সাংবাদিক সমাজ, সৃজনশীল মানুষ ও নাগরিক বিবেকের জন্য এক কঠিন প্রশ্ন রেখে গেছে। এ ঘটনায় আমরা গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করছি। স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের মৃত্যু যেন আরেকটি ‘সংবাদ’ হয়ে হারিয়ে না যায়। আমরা চাই, তার মৃত্যু হোক পরিবর্তনের সূচনা, ন্যায়বিচারের জাগরণ।
আমাদের স্পষ্ট তিন দফা দাবি:
১️. যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে অভিযুক্ত যৌননিপীড়ক আলতাফ শাহনেওয়াজসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবিলম্বে আইনের মুখোমুখি করতে হবে।
২️. ঢাকা স্ট্রিম কর্তৃপক্ষের ভূমিকা ও অবহেলা তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
৩️. কর্মক্ষেত্রে নারীদের নিরাপত্তা, সম্মান ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ নীতিমালা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।’’
বিবৃতিতে সম্মতি জানিয়েছেন যারা, তাদের মধ্যে আছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আইনজীবী জেড আই খান পান্না, ঢাবি অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ আব্দুল বায়েস, ঢাবি অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, কবি গুলতেকিন খান, ঢাবি অধ্যাপক ও গবেষক ড. কামরুল হাসান মামুন, ঢাবি অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন, ১২. অভিনেতা ও নাট্যপরিচালক কচি খন্দকার, কথাশিল্পী রফিকুর রশীদ, কথাশিল্পী নাসরীন জাহান, কবি ও কথাসাহিত্যিক ঝর্না রহমান, লেখক ও সাংবাদিক হাসান শান্তনু, কবি ও অনুবাদক জুয়েল মাজহার, গবেষক সাদাত উল্লাহ খান, আইনজীবী মানজুর আল মতিন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন, চলচ্চিত্র নির্মাতা দীপংকর দীপন ও রবীন্দ্র গবেষক প্রবীর বিকাশ সরকার।
আরো আছেন কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক লায়লা ফেরদৌস হিমেল, শিশুসাহিত্যিক হুমায়ূন কবীর ঢালী, কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার ড. মুকিদ চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রকাশক মজিবর রহমান খোকা, কবি রইস মুকুল, লেখক ও চলচ্চিত্র সমালোচক বিধান রিবেরু, কবি বিনয় কর্মকার, গীতিকার ও সুরকার শেখ সাইফুল্লাহ রুমী, কবি আসমা অধরা, কবি ও সাংবাদিক গাজী মুনছুর আজিজ, কবি ও শিক্ষক রনজু রাইম, কবি ও সাংবাদিক নওশাদ জামিল, কবি অনিকেত শামীম, কবি ও প্রকাশক শরীফা বুলবুল, কবি ও কথাসাহিত্যিক আহসান হাবিব, কথাসাহিত্যিক মনি হায়দার, কবি ও প্রকাশক সৈকত হাবিব, কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা ড. মাসুদ পথিক, কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান, নাট্যকার ও কথাসাহিত্যিক রুমা মোদক প্রমুখ।
খবরটি শেয়ার করুন