সোমবার, ২০শে অক্টোবর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৪ঠা কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ

*** পাকিস্তান দেখাল কীভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ‘ডিল’ করতে হয় *** দেশে লাগাতার অগ্নিকাণ্ডে স্বরাষ্ট্রসচিবের নেতৃত্বে সরকারের কোর কমিটি *** নাহিদের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় যা বলল জামায়াত *** প্রথম আলোর আলোচনায় জুলাই সনদ *** আলোচনা-সমালোচনায় কবি-সাংবাদিক আলতাফ, সহকর্মীরা প্রতিবাদমুখর, সরব নারীনেত্রীরা *** জামায়াত সম্পর্কে কী এনসিপির নতুন উপলব্ধি *** খালেদা জিয়ার সংসদ নির্বাচনের প্রচারে অংশ নেওয়ার বিষয়ে যা জানাল বিএনপি *** একের পর এক অগ্নিকাণ্ড নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জরুরি বৈঠক *** জামায়াতসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর নতুন কর্মসূচি *** আন্দোলনের জবাবে ট্রাম্প বললেন, ‘আমি রাজা নই’

প্রথম আলোর আলোচনায় জুলাই সনদ

বিশেষ প্রতিবেদক

🕒 প্রকাশ: ১১:১৯ অপরাহ্ন, ১৯শে অক্টোবর ২০২৫

#

ছবি: সংগৃহীত

দেশের অন্যতম প্রভাবশালী বাংলা দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো দাবি করছে, কয়েকটি রাজনৈতিক দলের স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ ‘মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটি প্রচেষ্টা’। পত্রিকাটির দাবি, রাজনৈতিক দলগুলোর জুলাই সনদে স্বাক্ষর করাটা ‘এককথায় ঐতিহাসিক’ এবং ‘স্বাক্ষরের ঘটনা নিঃসন্দেহে দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রার এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক’।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের শক্তি হিসেবে গঠিত হওয়া রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) চারটি বামদলের ওই সনদে স্বাক্ষর করতে সম্মত না হওয়ার বিষয়কে পত্রিকাটি চিহ্নিত করছে ‘দেশের গণতান্ত্রিক যাত্রার নতুন সূচনার পথে তাদের এমন অবস্থান দুর্ভাগ্যজনক’ হিসেবে। তবে জুলাই সনদ একটি বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যাশা জাগিয়েছে। গতকাল শনিবার (১৮ই অক্টোবর) প্রকাশিত প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে এসব কথা বলা হয়।

প্রথম আলোর এমন দাবি নিয়ে ফেসবুকসহ অনলাইনকেন্দ্রিক অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানামুখী আলোচনা চলছে নেটিজেনদের মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা জুলাই সনদে করা হয়েছে বলে বর্তমান সরকার সমর্থক বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। জুলাই সনদ প্রণয়নের আগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে অংশ নেওয়া চারটি বামদল সনদে স্বাক্ষরের আগেই জানায়, বিদ্যমান সংবিধানের চার মূলনীতিকে বাদ দিয়ে জুলাই সনদ হলে সেই সনদে স্বাক্ষর করবে না।

তাদের অভিযোগ, জুলাই সনদে মুক্তিযুদ্ধ ও আন্দোলনের ইতিহাস সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। এতে প্রথমে একাত্তরের স্বাধীনতার ঘোষণার কথা বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়, যা দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি। তা বাদ দিলে দেশের অস্তিত্ব থাকে না। অবশ্য চারটি বামদলের আপত্তির পর জুলাই সনদে পরিবর্তন আনা হয়। এর ফলে সংবিধান থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাদ পড়েনি। এমন পরিস্থিতিতে প্রথম আলোর ওই দাবি নানা আলোচনা, পর্যালোচনা, বিশ্লেষণের জন্ম দিচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যে কোনো রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের অবস্থান কী, বিষয়টিকে তারা কীভাবে বিবেচনা করছে, তা স্পষ্ট হয় তাদের সম্পাদকীয়ের মাধ্যমে। স্বাক্ষরিত জুলাই সনদ নিয়ে প্রথম আলোর অবস্থান ওই সম্পাদকীয়ের মাধ্যমে স্পষ্ট করা হলেও এতে সরকার ও কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে খুশি করার প্রবণতা আছে। বিষয়টি সংবাদমাধ্যমের প্রকৃত দায়িত্বের সঙ্গে বেমানান। পাঠকনন্দিত পত্রিকা হিসেবে যে দায়িত্ববোধ থেকে এই বিষয়ে সম্পাদকীয় পাঠক আশা করে, তা ওই সম্পাদকীয়তে নেই।

পত্রিকাটি জুলাই সনদের গঠনমূলক অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক এড়িয়ে গিয়ে সরকার ও নির্দিষ্ট কিছু রাজনৈতিক দলকে খুশি করায় বেশি ব্যস্ত। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের কাছ থেকে গঠনমূলক সমালোচনা প্রত্যাশার কথা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে। তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম একাধিকবার বলেছেন, সরকার গণমাধ্যমের নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রত্যাশা করে। গণমাধ্যমের গঠনমূলক সমালোচনা সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে।

বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, জুলাই অভ্যুত্থানের সময় এবং এর পরপর আগস্ট মাসে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডসহ কিছু অপরাধের বিচার হবে, আবার কোনোটির বিচার চাওয়া যাবে না–এ রকম পরিস্থিতি তৈরির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত ‘হত্যাকাণ্ডের বিচার’, অন্যদিকে ‘আইনগত দায়মুক্তির’ বিষয়টি একই সঙ্গে রাখা হয়েছে সনদে। বিষয়টি ভবিষ্যতে নতুন সংকটের জন্ম দিতে পারে।

তাদের মতে, কারও কোনো পদক্ষেপ অপরাধ হিসেবে প্রমাণ হলে তার শাস্তি সবার জন্যই এক হওয়া উচিত। বিচার চাওয়ার অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা আইনসম্মত নয়। জুলাই সনদে ঢালাও দায়মুক্তির সুযোগ রাখা ভবিষ্যতে সনদটিকে বিতর্কে ফেলে দিতে পারে। ওই সনদে ‘শহীদ পরিবার’ ও ‘আহত বীর যোদ্ধাদের’ আইনগত দায়মুক্তি, মৌলিক অধিকার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত হলেও কারা কী ধরনের অপরাধ বা কর্মকাণ্ডের জন্য দায়মুক্তি পাবেন, তা নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি।

তবে দায়মুক্তির মাধ্যমে ঘটনার যে রাজনীতিকায়ন হয়, সেখান থেকে নতুন বিতর্ক জন্ম হয়। ‘দায়মুক্তি’র মতো বিষয়টিও সম্পাদকীয়তে এড়িয়ে গেছে প্রথম আলো। গত ১৭ই অক্টোবর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্বাক্ষরের জন্য তৈরি করা সনদে প্রথমে ‘দায়মুক্তি’ প্রসঙ্গটি রাখা হয়নি। পরে ‘জুলাই শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধা’ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই সনদের অঙ্গীকারনামায় সংশোধনী এনে ‘দায়মুক্তির’ বিষয়টি সংযোজন করা হয়।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহ্দীন মালিক এ বিষয়ে গণমাধ্যমে বলেন, দায়মুক্তি বিষয়টি অসাংবিধানিক, এর কোনো অবকাশ দেশের সংবিধানে নেই। কীসের থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হবে, তাও স্পষ্ট না। অন্যায়ের শিকার হলে কেউ বিচার চাইতে পারবেন না, এটি হতে পারে না। কাউকে বিচার পাওয়ার অধিকার চাওয়া থেকে আটকানো যায় না। জুলাই আন্দোলনের বিষয়ে সরকার এভাবে দায়মুক্তির কথা না বলে কৌশলে এর সমাধান করতে পারতো।

আইনজ্ঞরা বলছেন, বহুল আলোচিত এ জুলাই সনদ ভালো উদ্দেশ্যে করা হলেও এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে যথেষ্ট ধূম্রজাল রয়েছে। এ সনদের অনেক ধারা বিদ্যমান আইন ও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। পাশাপাশি সনদে এমন কিছু ধারা আছে যা এরই মধ্যে অকার্যকর হয়ে গেছে। 

এই সনদে সংবিধান, নির্বাচন ও বিচার ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমনসহ বেশ কিছু সংস্কারের সুপারিশমালা রয়েছে। তবে দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর যে জুলাই সনদ চূড়ান্ত হয়েছে সেখানে শ্রমিক অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, নারীর অধিকার নিয়ে তেমন কিছুই নেই বলে মনে করছেন অনেকে। স্বাভাবিকভাবে জুলাই সনদ নিয়ে মানুষের মধ্যে যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, তা অনেকাংশেই পূরণ হয়নি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এসব বিষয়ে গঠনমূলক কোনো সমালোচনার কথা উল্লেখ নেই প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে।

উল্লেখ্য, সাত দফা অঙ্গীকারনামার ভিত্তিতে প্রণীত ৪০ পৃষ্ঠার জুলাই সনদের তিনটি ভাগের মধ্যে প্রথম ভাগে পটভূমি, দ্বিতীয় ভাগে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব এবং তৃতীয় ভাগে সনদ বাস্তবায়নের সাত দফা অঙ্গীকার রয়েছে। এই সনদের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ৪৭টি বিষয়কে ‘সংবিধান সংশোধন সাপেক্ষে সংস্কার’ এবং বাকি ৩৭টি বিষয়কে ‘আইন বা অধ্যাদেশ, বিধি ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সংস্কার’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ঐকমত্য কমিশন। কিছু সংস্কার প্রস্তাবের ক্ষেত্রে কিছু দলের ভিন্নমত ও ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রয়েছে।

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর প্রত্যাশিত জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরিত হয় গত শুক্রবার বিকেলে। জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আনন্দমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় এই স্বাক্ষর অনুষ্ঠান। ২৪টি রাজনৈতিক দলের ৪৮ জন প্রতিনিধি আনুষ্ঠানিকভাবে সনদে সই করেন। এরপর সই করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ কমিশনের সদস্যরা।

দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, স্বাক্ষরিত এই দলিল কেবল একটি রাজনৈতিক চুক্তি নয়, বরং এটি নাগরিকদের সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রের একটি সামাজিক চুক্তি। গণ-অভ্যুত্থানের স্বপ্নকে ধারণ করে রচিত এই সনদ প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের ভাষায় ‘নবজন্ম’। বর্বরতা থেকে সভ্যতায় যাত্রা শুরুর নামান্তর। দীর্ঘদিনের আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে এই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।

প্রথম আলো জুলাই জাতীয় সনদ

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন

Footer Up 970x250