ছবি - সংগৃহীত
রবিউল হক
বাংলাদেশের সর্ব-উত্তরের জেলা পঞ্চগড় নানা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। লোকসংস্কৃতির নানা উপাদানে পরিপূর্ণ এ জেলা। এ জেলায় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে প্রচলিত খাদ্যাভ্যাসে রয়েছে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। জেলায় শাক-সবজি, মাছ-মাংসসহ সব ধরনের তরকারিকে ‘শাক’ বলে অভিহিত করা হয়। প্রায় সকল রান্নায় ঝোল রাখার প্রবণতা দেখা যায়। এছাড়া মজা গুয়া (সুপারি) এ অঞ্চলের জনপ্রিয় খাদ্য উপকরণ যা এ অঞ্চলের কাঁচা গুয়া ও সুপারি দুই নামেই পরিচিত।
সকাল বেলা আহারাদি হিসেবে এ জেলার লোকজনের মধ্যে খড়খড়া ভাত, তেল ও মরিচে ভাজা বৌ-খুদা, মরিচ-পান্তা, খৈ ও মুড়ি, গুড়ের চায়ের সাথে মুড়ি খাওয়ার রীতি প্রচলিত। পিঠা হিসেবে এ অঞ্চলে ভাপা চিতুয়া পিঠা, চালের গুঁড়ার রুটি ও গুড় দিয়ে চালের গুঁড়ার ক্ষীর বেশ জনপ্রিয়। পঞ্চগড় জেলায় ঐতিহ্যবাহী খাদ্যের মধ্যে আমশির খাটা, মিষ্টি আলুর পাতা, কলমি শাক, কুমড়ার বিচ্চি (বিচি), কাঁচা কাঁঠালের শাক, কাঁঠালের মচ্কা (মোচা), কাঁঠালের বিচ্চি, কেলার মচ্কা (কলার মোচা), কালা কচু, সাদা কচু, মান কচু, কাচা কলার ভর্তা ও বড়া, কুমড়ো গাছের লতাপাতা, কচুর নেউল, কাকিরী শাক, কাউনের ভাত, কড়কড়া বা খড়খড়া ভাত (রাতের বাসি শক্ত ভাত), খুদের ভাত বা বৌ-খুদা (চালের ভাঙা ক্ষুদ্রাংশ), গাবথোর বা কলা গাছের ভেতরের মসৃণ অংশ, ঘিমা শাক, চিরামিরা শাক, চামঘাসের ভর্তা, চুকা শাক, কচুর ছ্যাকা, টেমাটাল খাটা বা টমেটোর টক, ট্যাপেরাই শাক, ঠাকুরী কালাই (মাস কলাই) বড়া, ডাউয়া, ঢেমসির ভাত, ঢেমসির গুঁড়া, ঢেকীয়া শাক, দলঘড়িয়া শাক, দহিচুড়া, নিম পাতার ভাজি, প্যালকার ঝোল, ভুট্টা ও গমের ছাতু, শাপলা ফুলের শাক, পবা শাক, জলপাইয়ের খাটা, টেমাটোলের (টমেটোর) চাটনী উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও পহেলা বৈশাখের খাবার হিসেবে ফকতাই, ফড়ুয়া, পাতাকপি বা বাঁধাকপি-শুটকি, বাবড়ী শাক, বথুয়া শাক, ভোগদানের পায়েস, গোসতোর কষা পাক, মষ্টি কুমড়ার ফুলের বড়া, মানা বা মান কচু, শাপলার ফুলের সাথে ডালের ঘন্ট, শপ শাক, সিদলের ভর্তা, রসুন পাতা কাঁচা মরিচের ভর্তা, পেঁয়াজ পাতার ভর্তা ও ভাজি, লেবুপাতার খাট্টা, লাফা শাক, বাঁশের টেকা বা মুখি দিয়ে হাঁসের তরকারি, প্যালকা শাক (বিভিন্ন শাক-সবজির পাতা দিয়ে তৈরি), খুড়িয়া শাক, মানার শাক, শুক্তার শাক প্রভৃতি বেশ জনপ্রিয়।
পঞ্চগড় জেলায় লোকজ পিঠা খাওয়ায় কিছুটা বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। এ জেলার প্রচলিত পিঠার মধ্যে কেলা পিঠা বা কলা পিঠা, কাঁঠাল পিঠা, উট পিঠা বা ঝাল পিঠা, চাইর খোলা বা আট খোলা পিঠা, পকন পিঠা (তেলের পিঠা), খিলি পিঠা, গুলগুল্লা পিঠা, গুড়গড়িয়া পিঠা, ছিটা পিঠা, চিতুয়া বা চিতুই পিঠা, ছাচ পিঠা, সিরিঞ্জ পিঠা, ডিমা পিঠা, তাল পিঠা, চাউলের আটার পিঠা, নারকেল কুলি (পুলি), দুধ কুলি (পুলি), পানি পিঠা, বড়া পিঠা, ভাকা পিঠা বা ভাঁপা পিঠা, দুধের পিঠা বা দুধ চিতই, অন্দশা পিঠা, নুনুয়া নুনুহাস পিঠা প্রভৃতি বেশ জনপ্রিয়।
মূলত পিঠা তৈরির মধ্যদিয়ে গ্রামের শ্বাশ্মত নারীর শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে। পিঠা বানানো ও খাওয়ার ব্যাপক আয়োজন বাঙালির নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকেই তুলে ধরে।
তথ্যসূত্র :
১. নাজমুল হক, উত্তরবঙ্গের লোকসাহিত্যর নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক সমীক্ষা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০৭
২. শামসুজ্জামান খান (সম্পা.), বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা: পঞ্চগড়, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৩
রবিউল হক, লোক গবেষক ও শিল্পী
আই.কে.জে/