১৯৭১ সালের মার্চের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে দেশের একক নিয়ন্ত্রণ চলে আসে। তিনি প্রতিদিন নতুন নতুন নির্দেশনা দিয়ে জাতিকে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য গড়ে তোলেন। এরপর ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদাররা ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন।
ওয়ারলেসের মাধ্যমে বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ঘোষিত হয় স্বাধীনতার ঘোষণা। এর পরপরই সেই বার্তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিলি করা হয়। আন্তর্জাতিক বিশ্বেও তোলপাড় শুরু হয়। পরদিন ২৭শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিশ্বের স্বনামধন্য গণমাধ্যমগুলোতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানায়, ‘পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এক গোপন বেতার থেকে জনসাধারণের কাছে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন।’
ভয়েস অব আমেরিকা জানায, ‘ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। শেখ মুজিবুর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন এবং সারা বিশ্বের কাছে সহযোগিতার আবেদন জানিয়েছেন।’
দিল্লি থেকে প্রকাশিত স্টেটসম্যানের খবর ছিল, ‘পাকিস্তানি বাহিনীর অভিযানের প্রতিবাদে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি এক গোপন বেতার ভাষণে পাকিস্তানের পূর্বাংশের নাম স্বাধীন বাংলাদেশ বলে ঘোষণা করেছেন।’
লন্ডনভিত্তিক দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ ২৭শে মার্চ লিখেছিল—‘পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ: শেখ একজন বিশ্বাসঘাতক, বলেছেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট।’
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান লিখেছিল—‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ২৬শে মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণ দেন। এরপরই দ্য ভয়েস অব বাংলাদেশ নামে একটি গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন অন্য এক ব্যক্তি।’
২৭শে মার্চ মার্কিন সংবাদমাধ্যম টাইমসে ‘পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহী নেতা আটক’ শিরোনামে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পাকিস্তান রেডিও আজ জানিয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
নিউইয়র্ক টাইমসের আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। ইতিমধ্যে মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনী শেখের বাহিনীর (শেখ মুজিবুর রহমান) সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ করছে।’
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছিল, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন’। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধে হতাহত বাড়ছে। অন্তত ছয়টি সেনানিবাস ঘিরে ফেলেছে পিন্ডির সৈন্যরা। শেখ মুজিবুর রহমান এরই মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর কবল থেকে দেশকে পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন।’
২৭শে মার্চ দ্য আইরিশ টাইমসের ‘পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতার ঘোষণা: ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘একটি গোপন রেডিও স্টেশন থেকে গত রাতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে প্রবল যুদ্ধ চলছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে।’
বার্তা সংস্থা মিশিগান ডেইলির শিরোনাম ছিল, ‘বিপ্লবের ডাক’। প্রতিবেদনে লেখা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি সর্বস্তরের জনগণকে আন্দোলনে নামার আহ্বান জানান।’
ব্যাংকক পোস্ট ‘গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পাকিস্তান’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ‘পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বীকৃতি না দেওয়ায় সেখানে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান ইতিমধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।’
যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন থেকে প্রকাশিত পত্রিকা দ্য বুলেটিনের শিরোনাম ছিল—‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত শুরু।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আজ পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।’
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিভিত্তিক দ্য সানডে মর্নিং হেরাল্ড ‘বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত’ শিরোনামে খবর প্রকাশ করেছিল। খবরে বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটছে, তা জানা অসম্ভব। রেডিও পাকিস্তানের মতে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমান বন্দী...।’
১৯৭১ সালের ২৭শে ও ২৮শে মার্চ ভারত, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ আফ্রিকা, কানাডা, হংকং, নরওয়ে, জাপান, তুরস্ক ও সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের প্রায় ৯০টি দেশের পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ও গণহত্যার খবর প্রকাশিত হয়েছিল।
এইচ.এস/
