ছবি: সংগৃহীত
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কিনা–এ নিয়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে নতুন করে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে নতুন বিতর্কে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। ফলে নির্বাচনের পিছু ছাড়ছে না 'সংশয়, সন্দেহ, অনিশ্চয়তা'।
এখন আবার ওই শব্দগুলোই নতুন করে আলোচনায় আসছে নির্বাচন প্রশ্নে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ফেব্রয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে বারবার। সেই প্রতিশ্রুতির পর একপর্যায়ে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের নেতাদের বক্তব্যে এমন ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে গেছে; নির্বাচন হচ্ছে ফেব্রুয়ারিতেই। বিএনপিসহ দলগুলো নির্বাচনমুখী তৎপরতাও শুরু করে।
এরপরও এখন ভোটের ব্যাপারে নতুন করে সন্দেহ, সংশয়ের কথা আসছে। নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে অনেকে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। বিএনপি ও এর মিত্রদের মধ্যে নতুন করে সন্দেহ বা সংশয়ের কারণ কী–এ প্রশ্নে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে অনেকটা একই ধরনের জবাব পাওয়া যায়। বর্তমান পরিস্থিতিকে 'অস্পষ্ট' বলে বর্ণনা করছেন বিএনপি নেতাদের মধ্যে অনেকে। তারা বলছেন, এ ধরনের পরিস্থিতির কারণে নির্বাচন নিয়ে তাদের সংশয়, সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
বিষয়গুলো উঠে এসেছে বেসরকারি টিভি চ্যানেল বাংলা ভিশনের টকশো 'ফ্রন্ট লাইনের' গতকাল মঙ্গলবারের (২৩শে সেপ্টেম্বর) আলোচনায়। দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঞ্চালনায় ওই অনুষ্ঠানে দেশের মানুষের মধ্যে নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, এসব নিয়ে কথা বলেছেন ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা নিউ এজের সম্পাদক নূরুল কবীর। তিনি বলেন, এক ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। সেটা প্রধানত সরকারের কারণে তৈরি হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর কারণে তৈরি হয়েছে।
তার মতে, 'নির্বাচনের ব্যবস্থা সরকার করবে এবং রাজনৈতিক দলগুলো এতে অংশগ্রহণ করবে। আমরা জনগণ ভোট দেব। এর মধ্যে ভোট যারা দেয়, তাদের এগুলোর নীতি প্রণয়ন করার কোনো সুযোগ থাকে না। সরকার (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) তো বহুদিন থাকতে চেয়েছিল। সামনের বছরের মধ্য ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের আয়োজনের কথা। এটা তো রাজনৈতিক চাপের কারণে, বিএনপি ও অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর চাপের কারণে সামনের বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে ঠিক হয়েছে।'
তিনি মনে করেন, 'আসলে আজকে আমরা যে সমস্যা দেখছি, এর উৎপত্তি ২০২৪ সালের আগস্টের ৫ থেকে ৮ তারিখের মধ্যে। গণতন্ত্রপরায়ণ শিক্ষার্থীদের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে (আওয়ামী লীগের) স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতনের পর যাত্রাটা থাকার কথা ছিল গণতান্ত্রিক রূপান্তরের দিকে। সেটা করবার জন্য ইন্টেরিম সরকার গঠন করা হল। তখন সবচেয়ে বড় ভুল ছিল যে, অন্তর্বর্তী সরকার কত দিনের মধ্যে কী করবে, এর সম্ভাব্য রূপরেখা সেদিনই ঠিক না করা। কখনোই গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য থাকতে পারে না।'
প্রসঙ্গত, গত ১৭ই আগস্ট বেসরকারি টিভি চ্যানেল আইয়ের তৃতীয় মাত্রার আলোচনায় সম্পাদক পরিষদের সহসভাপতি নূরুল কবীর বলেন, সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ইন্টেনশন হলো, ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন দিয়ে একটা সম্মানজনক বিদায় নেওয়া। গভর্নেন্সের দিক থেকে কোনো গুণগত উত্তরণ সংঘটিত হয়নি বলে যারা অতি উৎসাহী হয়ে সরকারকে আরো প্রলম্বিত করে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে চান, তাদের উৎসাহে কিছুটা ভাটা পড়েছে।
নূরুল কবীর সেদিন বলেন, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন যাতে এত তাড়াতাড়ি, মানে ফেব্রুয়ারির মধ্যে সংগঠিত না হয়, তার জন্য বহু ধরনের রাজনৈতিক শক্তি সক্রিয় ছিল। হয়তো এখনো আছে। কিন্তু সরকারের কতগুলো গভর্নেন্স ফেইলিউরের জন্যে সরকারের ভেতরেও যারা বিরোধিতা করতেন, তারা আমার ধারণা, ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছেন যে, এটা তাদের পক্ষে আরো দূরবর্তী পর্যায়ে টেনে নেওয়া সম্ভব হবে না।
২৩শে সেপ্টেম্বরের টকশোতে নূরুল কবীর বলেন, সরকারের একটা সময়সীমা থাকে, একটা মেয়াদ থাকে। সেই মেয়াদটা সেদিন যারা যারা এই সরকার গঠনের প্রক্রিয়ায় ছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলো এবং সেনাবাহিনী, তারা হয় ভুলে গিয়েছিলেন অথবা তারা অতিরিক্ত আস্থা অধ্যাপক ইউনূস এবং তার সরকারের ওপর রেখেছিলেন। তারা ধরে নিয়েছিলেন, রিজনেবল টাইমের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার কতগুলো কাজ করে চলে যাবে। কাজগুলো কিছুই না। আমরা যদি ইউনূস সরকারের কথাই বলি, তিনটা মূল কাজ।'
তিনি বলেন, '২০২৪ সালের মধ্য জুলাই থেকে বিশেষত আগস্ট মাসের ৫ তারিখ সকাল পর্যন্ত তৎকালীন সরকার ক্ষমতা আঁকড়ে থাকবার জন্য অন্যায়ভাবে প্রায় প্রতিদিন ৪০-৫০ জন করে তরুণ-শিশু-বৃদ্ধকে গুলি করে হত্যা করেছে, সেটার বিচার হওয়া তো জরুরি। সে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করবে। যেই রাজনৈতিক ব্যবস্থার কারণে বারবার নানা ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, সেইটা প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার জন্য যে সাংবিধানিক এবং আইনগত পরিবর্তন দরকার, সেই সংস্কারগুলো করবে এবং সেগুলোর প্রক্রিয়া শেষ হলে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।'
তিনি বলেন, 'গত বছরের আগস্ট মাসে সরকার যখন ক্ষমতায় এল এবং ধীরে ধীরে এক মাস, দু-মাসের মধ্যে যখন কথা শুরু হল, এই সরকারের মেয়াদ কত দিন, এতে কয়েকজন মন্ত্রী বিরক্ত হয়েছিলেন। তাদের চাল-চলন, ধীরতা, শারীরিক ভঙ্গি- এগুলো দেখলে মনে হয় চার-পাঁচ বছরের জন্য তারা ক্ষমতায় এসেছেন। অর্থাৎ তাদের মাথায় এরকম কোনো গণতান্ত্রিক চৈতন্য সক্রিয় ছিল না যে একটা সরকার অনির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য এবং দেশে যখন কোনও নির্বাচিত প্ল্যাটফরম নেই যাদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেগুলোর অনুপস্থিতিতে এত বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার অর্থ হচ্ছে আরেকটা স্বেচ্ছাচারিতা প্রতিষ্ঠা করা।'
তিনি বলেন, 'যাই হোক, রাজনৈতিক দলগুলো, যারা ক্ষমতার জন্য লড়াই করবে, তারা আপন আপন কর্মসূচি নিয়ে, তারা যখন এগুলো বুঝতে পারল, সমাজে এক ধরনের যেমন প্রশ্ন উঠল, তাদের মধ্যেও কথা উঠল, তারা ডিসেম্বরেই নির্বাচন চাইল, সেনাবাহিনীর প্রধানও ১৮ মাসের মধ্যে, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাইলেন। আর এই প্রক্রিয়াগুলো চলতে থাকল। মানুষ দেখল যে বিচার প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে। সেটা স্লোলি হলেও চলছে।'
তিনি বলেন, 'সংস্কার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে যেটা দাঁড়াল, সরকার নিজে কোনো সংস্কার কর্মসূচি নিল না। তারা একদিকে রাজনৈতিক দলগুলোকেই যেহেতু শেষ পর্যন্ত সংস্কার কার্যক্রম করতে হবে, সুতরাং তাদেরকে এনগেজ করে নানা কমিশন করল। শেষে অন্যদের বাইরে রেখে কেবল ছয়টা কমিশনকে একত্রিত করে সাংবিধানিক রাজনৈতিক, আইনগত আর কতগুলো বিষয় ঐকমত্য হওয়ার জন্য পলিটিক্যাল ক্লাসের সঙ্গে আলাদা করে ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলছে।'
নূরুল কবীর বলেন, এটার জন্য এতদিন লাগার কোনো দরকার ছিল না। এখন যে পর্যায়ে এসেছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে একটা রাজনৈতিক দল আরেকটা রাজনৈতিক দলের প্রতি আপন আপন কর্মসূচি চাপিয়ে দিতে চাইছে। এটা না করলে নির্বাচন হবে না, ওটা না করলে নির্বাচন হবে না, আমরা এটা বিশ্বাস করি না। আরেক দল বলছে এটা তো আমি মানি না। প্রত্যেকটা দলের আলাদা আলাদা রাজনীতি আছে। এই কারণে আলাদা রাজনীতির দল। তাদের ভাবাদর্শ আছে। কর্মসূচি আছে। এই প্লাটফরমটাকে ব্যবহার করে এই যে প্রক্রিয়াটাকে বিলম্বিত করছে, সেটাই মানুষের মনের মধ্যে সংশয় তৈরি হওয়ার একটা কারণ।'
তিনি বলেন, 'দ্বিতীয়ত যারা চিন্তাশীল মানুষ, তাদের মধ্যে অস্থিরতা আছে। সংশয় কতটুকু আছে জানি না। সেটা হচ্ছে, যতগুলো কমিশন গঠন করেছিল সরকার, সে কমিশনগুলো অনেক ধরনের রিকমেন্ডেশনস দিয়েছে। পলিটিক্যাল এবং কনস্টিটিউশনাল রিকমেন্ডেশনসের বাইরে। সেগুলোর মধ্যে অনেকগুলো সরকার বাস্তবায়ন করতে পারত। সরকারের নিজের যেমন কোনো সংস্কার কর্মসূচি নেই, তাদের গঠিত কমিশনগুলো যে সমস্ত সংস্কারের কথা বলছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে তেমন তাৎপর্যপূর্ণ কোনো উদ্যোগ আমরা নিতে দেখি না।'
'এটা কেন করল না'- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, সরকারের রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক কমিটমেন্টের অভাব আছে। তাদের অধিকাংশই এনজিওভিত্তিক লোকজন, পলিটিক্যাল ভিশন নেই। তাদের একটা অংশ অনেকদিন ক্ষমতায় থাকবে ভেবে বেশ স্লোলি গেছে কয়েকমাস। ফলে এই যে এত রক্তপাত, তরুণ-শিশু-বৃদ্ধের মৃত্যু, এর মধ্যে এক বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে, রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে, পরিচালনার ক্ষেত্রে, গভর্ন্যান্সের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের আমলে বা তার আগের আমলে যে পদ্ধতিতে রাষ্ট্রযন্ত্র চলত, সে পদ্ধতির মধ্যে কোনো পরিবর্তন আছে? নেই।
খবরটি শেয়ার করুন