ছবি: সংগৃহীত
জ্যোতির্ময় নন্দী
উপমহাদেশে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা আবারও তুঙ্গে। ১৯৪৭-এ ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনাধীন ভারতবর্ষ বিভাজিত হয়ে ভারত বা হিন্দুস্তান এবং ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই একদার এক রাষ্ট্র থেকে আজকের দুই পড়শি রাষ্ট্রে পরিণত তাদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ চলেই আসছে। দেশ দুটো এ যাবৎ অন্তত বার পাঁচেক সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এ ছাড়া সীমান্ত এলাকাগুলোতে দু’পক্ষের মধ্যে খুচখাচ খুচরো হামলা গোলাগুলি তো লেগেই আছে।
অসংখ্য উদ্বাস্তু শরণার্থী-মোহাজেরের একসাগর রক্ত আর অশ্রুর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এসেছিলো এ দুই দেশের স্বাধীনতা। ভারত বিভাজনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলা ও পাঞ্জাবের মানুষ। দুটো রাজ্য বা প্রদেশই ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে যায়। অসংখ্য মানুষ দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়। বীভৎসতম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হতাহত, ধর্ষিত, লুণ্ঠিত, জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত ও বান্তুচ্যুত হয় কোটি কোটি মানুষ।
দু’দেশের, বিশেষ করে বাংলা ও পাঞ্জাবের কবি-সাহিত্যিকেরা তাদের লেখায় এই দুরপনেয় ঐতিহাসিক ক্ষতকে নানাভাবে ধরে রেখেছেন। তবে তাদের লেখায় কোনো বৈরিতা বা প্রতিহিংনা নয়, বরং পারস্পরিক গভীর সম্পর্ক, ভালোবাসা আর হারানোর তীব্র বেদনাই ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে। নিচে তিনজন ভারতীয কবির এ ধরনের চারটি কবিতার অনুবাদ করে দিলাম। এ তিন কবির মখ্যে একজন ভারতীয় উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী রাজ্য আসামের কন্যা, এবং বাকি দু’জনের জন্ম পাকিস্তানভুক্ত পশ্চিম পাঞ্জাবে, যদিও ১৯৪৭-এর পর তারা ভারতে অভিবাসিত হতে বাধ্য হন।
১. পাকিস্তান
[এ কবিতাটা লিখেছেন মামণি রাইসম গোস্বামী। এটা অহোমিয়া কবি, কথাশিল্পী, অধ্যাপিকা এবং পত্রিকা সম্পাদক ইন্দিরা গোস্বামী (১৪ই নভেম্বর, ১৯৪২ - ২৯শে নভেম্বর, ২০১১)’র কলমি নাম । তবে সাধারণ্যে তিনি মামণি বাইদেও নামেও সমধিক পরিচিত।
গোস্বামী তার সাহিত্যকৃতির জন্যে বহু পুরস্কার, সম্মাননা জয় করেছেন, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো বাংলা আকাদেমি পুরস্কার (১৯৮৩), জ্ঞানপীঠ পুরস্কার (২০০০) এবং প্রিন্সিপাল প্রিন্স ক্লজ লরিয়েট (২০০৮)। সমসাময়িক ভারতীয় সাহিত্যের অন্যতম স্বনামধন্য এ লেখিকার অনেক কাজ তার মাতৃভাষা অসমীয়া বা অহোমিয়া থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘দ্য মথ ইটেন হাওদাহ্ অফ দ্য টাস্কার’, ‘পেজ স্টেইনড উইথ ব্লাড’ এবং ‘দ্য ম্যান ফ্রম ছিন্নমস্তা’।
তিনি তার লেখা এবং সশস্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠী ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসাম আর ভারত সরকারের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেওয়ার মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন ও শান্তি আনয়নের প্রচেষ্টার জন্যও সুপরিচিত ছিলেন। তার কাজ মঞ্চে এবং চলচ্চিত্রে অভিনীত হয়েছে। তার উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘আদাজ্যা’ চলচ্চিত্রটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার জয় করে। জাহ্নু বড়ুয়া পরিচালিত ‘ওয়ার্ডস ফ্রম দ্য মিস্ট’ চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে তার জীবন কাহিনি অবলম্বনে।
কবি মামণি রাইসম গোস্বামীর কাব্যকৃতির পরিচয় হিসেবে তার ‘পাকিস্তান’ কবিতাটি তুলে ধরা হলো। ১৯৪৭-এ যখন ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির ট্র্যাজেডি রচিত হচ্ছে, তখন কবির বয়স বছর পাঁচেকের বেশি ছিল না, এবং দুঃখজনক ঘটনাটির প্রত্যক্ষ কোনো অভিজ্ঞতা বা সুস্পষ্ট স্মৃতি তার থাকার কথা নয়। তবুও তিনি এক দেশের এই দু’দেশ হয়ে যাওয়া নিয়ে পরিতাপ করেছেন। তবে এ নিয়ে পাকিস্তানকে তিনি কোনো দোষারোপ করেননি, বরং দু’দেশের মধুর একত্র অতীতের কথা তুলে ধরে পারস্পরিক হৃদয় বিনিময়ের আহ্বানই জানিয়েছেন বারবার। পাকিস্তানকে তিনি আখ্যায়িত করেছেন ‘স্বর্গীয় ভূমি’ হিসেবেই। ভারত-পাকিস্তানের আজন্ম সাপে-নেউলে সম্পর্কের লেশমাত্র ছাপ এ কবিতায় চোখে পড়ে না।]
হে পাকিস্তান, স্বর্গীয় ভূমি!
তোমার হৃদয় আমাদের দাও
আর বিনিময়ে নাও আমাদের হৃদয়!
একসময় আমরা একই আকাশ ভাগাভাগি করতাম!
একই সূর্যের আকাশ!
আমরা দুই যমজের মতো একই ব্যথা ভাগ করে নিয়েছি যুদ্ধক্ষেত্রে
ধুলো অপসারণ করতে গিয়ে
এখন আমাদের মাংস চিরে আলাদা করে ফেলা হয়েছে
ওই আঁকাবাঁকা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে!
হায় ওই বিভাজন রেখা তারা এঁকেছে
ফিনফিনে একটুকরো কাগজে!
সেই যন্ত্রণা আর অশ্রুর রেখা
যে-কেউ কি সে-রেখা আঁকতে পারে
আমাদের কাঁচা মাংসে, আমাদের হৃদয়ে?
বন্ধুরা! সুখে থাকো যেখানে আছো... আজ!
কবিরা বলেন, স্মৃতি কখনো ম্লান হয় না,
দূরত্ব এটাকে শুধু শুদ্ধ করে...
আমরা একই গাছের নিচে বসেছিলাম,
উপভোগ করেছিলাম একই ফুলের সৌরভ
যতক্ষণ না সেই সময়টা এসে
একটা ছোরার মতো
টুবরো টুকরো করে কেটে ফেললো
সেই নদীগুলোকে! ধ্বংস করলো
যত পাহাড় আর ফুলবাগান
যেখানে আমরা খেলতাম!
আর ওই নদীতীরগুলো
যেখানে বসে আমরা গুণতাম
ডুমুর রঙের ঢেউগুলো!
যেন মধুভরা ঠোঁট
মেয়েদের!
আমরা পরতাম একই পোশাক
আমাদের মায়েদের হাতে বোনা!
শীতকালে আমরা কেঁপেছি আর গরমকালে
আমাদের পিঠ বেয়ে নেমেছে ঘামের ধারা
আমরা স্বাদ নিয়েছি একই মদের
গালিব, মোমিন আর জউকের
কবিতা থেকে
আমরা ব্যথায় একসাথে কেঁদেছি!
রক্তমাখা আকাশের নিচে।
হে পাকিস্তান, স্বর্গীয় ভূমি!
তোমার হৃদয় আমাদের দাও
আর বিনিময়ে নাও আমাদের হৃদয়!
না আমাদের এখন কথা বলার দরকার নেই
শুধু নীরবতাই স্পষ্ট কণ্ঠে কথা বলে।
হে পাকিস্তান! নীরবতা আনতে পারে
মায়ের আত্মার সৌরভ।
নীরবতাই প্রকাশ করতে পারে শতদ্রুর,
চেনাবের, আর পুর্বের লোহিত নদীর
স্বর্গীয় সৌন্দর্য!
নীরবতা হতে পারে
লক্ষ কণ্ঠের মতো উচ্চকিত
হে পাকিস্তান! স্বর্গীয় ভূমি!
ফুটন্ত বারুদের ধোঁয়ায়
আমাদের চোখ বিভ্রান্ত!
অজানা আগুনে ক্ষতবিক্ষত আমাদের আত্মা!
এ চোখ যেন দেখতে পায় শতদ্রুর,
চেনাবের, আর পূর্বের লোহিত নদীর তীরে
নতুন নতুন যত সূর্যোদয়!
হে পাকিস্তান, স্বর্গীয় ভূমি!
তোমার হৃদয় আমাদের দাও
আর বিনিময়ে নাও আমাদের হৃদয়!
২. আজ ডাকছি ওয়ারিস শাহকে
[১৯৪৭-এর ভারত বিভাজন নিয়ে লেখা সবচেয়ে মর্মস্পর্শী কবিতা সম্ভবত পাঞ্জাবি কবি অমৃতা প্রীতম (১৯১৯-২০০৫)-এর ‘আজ আখন ওয়ারিস শাহ্ নূ’ (আজ আমি ডাকছি ওয়ারিস শাহকে)। অমৃতার জন্ম বর্তমান পাকিস্তানের গুজরানওয়ালায় এবং বড় হয়েছেন লাহোরে। ভারত বিভাজনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দুটি রাজ্য হলো পূর্বে বাংলা এবং পশ্চিমে পাঞ্জাব। তৎকালীন ভয়াবহতম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সর্বাধিক আক্রান্তও হয়েছে এ দুটি রাজ্য। ১৯৪৭-এর আগস্টে দাঙ্গা চলাকালে রক্তপ্লাবিত লাহোর থেকে অমৃতা প্রীতম আক্ষরিক অর্থে এক বস্ত্রে পালিয়ে এসেছিলেন নিজের বাচ্চাদের নিয়ে। পাঞ্জাবের বিখ্যাত বিয়োগাত্মক প্রেমকাহিনি ‘হীর-রঞ্ঝা’র রচয়িতা সুফি কবি ওয়ারিস শাহকে সম্বোধন করে অমৃতা প্রীতম পরে নিজ মাতৃভাষা পাঞ্জাবিতে রচনা করেন এই কবিতাটি, যেটি এখানে মূল পাঠ থেকে বাংলা অনুবাদ করে দেয়া হয়েছে।]
আজ ডাকছি ওয়ারিস শাহকে,
কবর থেকে কথা বলো।
তুমি আজ প্রেমের বইয়ের
পরের পাতা খোলো।
একদিন কেঁদেছিলো পাঞ্জাবের এক কন্যা;
তুমি লিখে ফেলেছিলে ক্রন্দনগাথা।
আজ কাঁদছে লাখো কন্যা,
কিন্তু ওয়ারিস শাহ্ তুমি কোথা?
ওঠো হে বেদনার বর্ণনাদাতা,
ওঠো, তাকিয়ে দেখো তোমার পাঞ্জাব।
আজ শস্যক্ষেত ভরে গেছে লাশে,
রক্তে ভরে গিয়েছে চেনাব।
কে মিশিয়ে দিল এত বিষ
আমাদের পাঁচটি নদীর জলে,
তাদের সে প্রাণঘাতী পানি দিয়ে
আমাদের গর্বের জমিতে সেচ চলে।
উর্বর এ জমির প্রতিটি রন্ধ্র থেকে
গজাচ্ছে বিষবৃক্ষের চারা,
আকাশ হয়ে যাচ্ছে রক্তিম
জমাট রক্তের ক্রন্দনে দিশেহারা।
বনের বিষাক্ত বাতাস
জেগে ওঠে অন্তর্ভেদী বিলাপে।
বদলে দেয় প্রতিটি বাঁশের বাঁশিকে
ভয়ঙ্কর বিষধর সাপে।
সাপের প্রথম ছোবলেই
সাপুড়ে তার মন্ত্র ভুলে গেছে,
দ্বিতীয় ছোবলে দেখো সব
একদম সাপ হয়ে গেছে।
ভয়ানক এই ঝর্না থেকে পান করে
এ ভূমি ভরছে সর্বনাশে।
ধীরে ধীরে পাঞ্জাবের সর্বশরীর
নীল হয়ে যাচ্ছে তীব্র বিষে।
গলিতে গলিতে গান থেমে গেছে,
তকলিতে সুতো ছিঁড়ে গেছে।
কিশোরীরা ছেড়ে গেছে সইদের,
চরকার ঘোরা থেমে গেছে।
আমাদের বাসরশয্যা এখন নৌকায়,
তাদের গুঁড়িগুলো ভেসে গেছে।
যার ডালে আমাদের দোলনা বাঁধা ছিলো
সেই পিপুলের ডাল ভেঙে গেছে।
হারিয়ে গিয়েছে সেই বাঁশি, যাতে
ফুঁ দিলেই শোনা যেতো হৃদয়ের সুর,
রনঝার ভাইয়েরা আজকে আর
জানে না সে সুর সুমধুর।
রক্ত ঝরছে আমাদের কবরে,
ভিজিয়ে দিচ্ছে মাটির গভীরে অবধি।
প্রেমের শাহ্জাদিরা আজ কাঁদছে
মাজারের দুয়ারে বসে নিরবধি।
আজকে সবাই কয়েদি,
সব চোর সৌন্দর্য ও ভালোবাসার।
কোথায় খুঁজে পাবো আজ
একজন ওয়ারিস শাহ্ আর।
আজ ডাকছি ওয়ারিস শাহকে,
কবর থেকে কথা বলো।
তুমি আজ প্রেমের বইয়ের
পরের পাতা খোলো।
৩. শোন্ ভাইয়া
[ভারত ভাগের দুঃসহ বেদনার ছাপ বিশেষ করে বাংলা ও পাঞ্জাব এ দুই রাজ্য বা প্রদেশের কবি-লেখকদের অনেকের লেখাতেই আমরা দেখেছি। হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের প্রখ্যাত কবি, গীতিকার, গায়ক, সঙ্গীত পরিচালক শৈলেন্দ্রও এর ব্যতিক্রম নন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে তরুণ বয়সে কারাবরণকারী এ কবি তার অনেক কবিতা ও গানে দেশভাগের প্রবল প্রতিবাদ করে গেছেন। অনাকাক্সিক্ষত এ সংঘটনকে বিদ্ধ করেছের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের বাণে, যা আসলে তার বেদনাদীর্ণ হৃদয়ের অশ্রুধারা রক্তধারা ক্ষরণেরই নামান্তর।
শৈলেন্দ্রের জন্ম ১৯২৩ সালের ৩০শে আগস্ট পাঞ্জাবের পশ্চিমাংশে রাওয়ালপিন্ডিতে, যা বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। মৃত্যু ১৯৬৬ সালের ১৪ই ডিসেম্বর ভারতের মায়ানগরী মুম্বইয়ে। ভারত তথা পাঞ্জাবের বিভাজনের প্রতিক্রিয়ায় লেখা শৈলেন্দ্রের ছোট দুটি কবিতার বাংলা অনুবাদ এখানে পর পর দেয়া হলো।]
শোন্ ভাইয়া, শোন্ ভাইয়া,
দুজনের আঙিনা এক ছিলো, ভাইয়া।
শ্রাবণ ও কাজরা এক ছিলো, ভাইয়া,
সংঘাত প্রহরা এক ছিলো, ভাইয়া,
যোদ্ধা ছিলাম আমরা একই ময়দানের।
পরদেশী কেমন চাল চেলে গেলো,
মিথ্যে স্বপ্ন দিয়ে আমাদেরকে ছলে গেলো।
ওই ভয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে তো এসেছো,
কিন্তু এক বাড়িকে বানিয়েছো দুই উঠানের।
৪. জ্বলে যাচ্ছে পাঞ্জাব
জ্বলে যাচ্ছে, জ্বলে যাচ্ছে আমার পাঞ্জাব প্যারা,
জ্বলে যাচ্ছে, জ্বলে যাচ্ছে ভগত সিংয়ের আঁখিতারা।
কে আমার জালিয়ানওয়ালাবাগে জ্বালালো আগুন?
কে ঝরালো দেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের খুন?
মায়ের সম্মতিকে মন্দ চোখে কে তাকালো?
জাত-ধর্মের চাদরে নিজের অসদুদ্দেশ্য কে ঢাকলো?
কে শুকিয়ে ফেলছে আমার পাঁচটি নদীর জলধারা?
জ্বলে যাচ্ছে, জ্বলে যাচ্ছে আমার পাঞ্জাব প্যারা।
জ্যোতির্ময় নন্দী: কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক।
আরএইচ/
খবরটি শেয়ার করুন