ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খানের সঙ্গে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের সাম্প্রতিক বাহাসের ঘটনায় আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠে। গত ৯ই সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের তৃতীয় তলায় আলোচনার কক্ষে ছাত্রদলের একাধিক নেতা, বিশেষ করে সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস উপাচার্যের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন বলে ফেসবুক ও ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা হয়। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের এ ধরনের আচরণ কোনোভাবেই সমর্থন করছেন না নেটিজেনরা।
সুখবর ডটকমের অনুসন্ধান বলছে, রাজনৈতিক মতবিরোধ, আদর্শিক বিভাজন ও স্বার্থের কারণে এ দেশে ছাত্র-শিক্ষকের শ্রদ্ধা-ভালোবাসার সম্পর্কেও ফাটল ধরেছে। তাদের সম্পর্কে চিরন্তন মূল্যবোধের উপস্থিতি প্রায়ই থাকছে না রাজনৈতিক কারণে। শিক্ষকের রাজনৈতিকভাবে অপদস্থ হওয়ার সময় চুপ থাকেন শিক্ষার্থীরা, আবার শিক্ষার্থীরা নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হলেও শিক্ষকেরা প্রতিবাদ করেন না রাজনৈতিক মতভিন্নতার কারণে।
ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কের এমন অবনতি কয়েক দশক ধরেই লক্ষ্য করে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সরাসরি ছাত্র ছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুই গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি ছাত্র ছিলেন আবুল হাসান মাহমুদ আলীর।
গত আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে একের পর এক রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা দায়ের ও তার কারাগারে যাওয়া ঠেকাতে আবুল হাসান মাহমুদ আলী সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী হয়েও কোনো ধরনের ভূমিকা রাখেননি। আবার গত বছরের ৫ই আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের সরকারের পতনের পর আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও তার পরিবার রাজনৈতিকভাবে বিপর্যয়কর অবস্থার মুখোমুখি হয়, এমন পরিস্থিতিতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও তার পরিবারের কোনো খোঁজ নেননি।
দুই ছাত্র এবং উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদও খবর নেননি তাদের শিক্ষক আবুল হাসান মাহমুদ আলীর। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদলের পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের স্কুল ও কলেজের শিক্ষক পদাধিকারীদের চাপ সৃষ্টি করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। তাদের মধ্যে উপাচার্য, অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষক যেমন আছেন, তেমনি আছেন সাধারণ শিক্ষকও। লাঞ্ছিত শিক্ষকদের তালিকায় তিন ছাত্র উপদেষ্টার সরাসরি শিক্ষকেরাও ছিলেন। ওই সময় তিন উপদেষ্টা মন্ত্রী পদে থেকেও শিক্ষকদের মব থেকে রক্ষা করতে কোনো ভূমিকা রাখেননি বলে অভিযোগ আছে।
তখন কোনো কোনো শিক্ষক সন্ত্রাসী হামলায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হয়েছেন। এমনকি নারী শিক্ষকেরা আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি। এই হীন স্বার্থ উদ্ধার করতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করা হয়েছে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু অনেক শিক্ষককেও পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। তিন ছাত্র উপদেষ্টা হলেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, যুব ও ক্রীড়া এবং স্থানীয় সরকার ও পল্লি উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে তারাসহ অন্যরা যখন সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হন, তখন তাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও এর কোনো প্রতিবাদ করেননি। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার, হত্যা ও নির্যাতন চলাকালে রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে প্রতিবাদ করেননি তাদের অনেক শিক্ষক।
তথ্যমতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহর ওপর ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে হামলার ঘটনা ঘটে। ঢাকার সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদের একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান থেকে বেরোনোর পর মাহবুব উল্লাহর ওপর হামলা করে অজ্ঞাতপরিচয়ের দুর্বৃত্তেরা। তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে, তারা হামলা চালিয়ে তার পোশাক ছিঁড়ে ফেলে। পরে আশপাশে থাকা লোকজন এগিয়ে গেলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়।
এ হামলার বিচার দাবি করেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ঘটনার নিন্দা জানান বিকল্পধারা বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। আবুল হাসান মাহমুদ আলী তখন আওয়ামী লীগের সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী। ছাত্র মাহবুব উল্লাহর প্রকাশ্যে নজিরবিহীনভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় শিক্ষক মাহমুদ আলীর বিবেকে কোনো সাড়া জাগাতে পারেনি।
আবুল হাসান মাহমুদ আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক। গত বছরের ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগেই দেশ ছাড়েন তিনি। সেই থেকে আছেন আত্মগোপনে। এরপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন তারই ছাত্র ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদও আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সরাসরি ছাত্র।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আবুল হাসান মাহমুদ আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৬৪ সালে। সালেহউদ্দিন আহমেদ ও ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ একই বিভাগে ১৯৬৫ সালে ভর্তি হন। তাদের সঙ্গে একই শিক্ষাবর্ষে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। তারও দুই বছর আগে একই বিভাগে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, ‘আমি ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। আর ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও সালেহউদ্দিন ভর্তি হন তারও দুই বছর পর, অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে। সেই অর্থে আবুল হাসান মাহমুদ আলী তাদের শিক্ষক ছিলেন। আমি নিজেও একপর্যায়ে তাকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। তবে তিনি আমাদের কোনো কোর্স পড়াননি।’
এসএসসি পাসের পর ১৯৬৩ সালে সালেহউদ্দিন আহমেদ ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভর্তি হন মানবিকে। তখনই মির্জা ফখরুল ও সালেহউদ্দিন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত হন। ১৯৬৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও মির্জা ফখরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন।
বুয়েট ও ঢাকা মেডিকেলে সুযোগ পান সালেহউদ্দিন আহমেদ। তবে তার কোনোটিতেই না গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে তিনিও ঢাবির অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। ওই সময় অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন আবুল হাসান মাহমুদ আলী। স্মৃতিচারণ করে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে আমরা চার-পাঁচ মাসের মতো পেয়েছি। উনি আমাদের মানি অ্যান্ড ব্যাংকিং বিষয়ে পড়াতেন।’
পেশাদার কূটনীতিক হিসেবে অবসর নেওয়ার পর আবুল হাসান মাহমুদ আলী ২০০১ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত বছরের ৮ই আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই দিনই তার সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে সালেহউদ্দিন আহমেদের দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় এক সপ্তাহ পর উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
তাদেরই বন্ধু মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরাসরি ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে না থাকলেও দেশের রাজনীতিতে বর্তমানে অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আবুল হাসান মাহমুদ আলীর বিষয়ে জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে স্যার আমাদের সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। আমরা ওনার ক্লাস পেয়েছি।’
দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নানা সময়ে ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। পরিবর্তন এসেছে সরকারেও। তবে কখনই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন কিংবা ক্ষমতার পালাবদলে কোনো অর্থমন্ত্রী কিংবা উপদেষ্টাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়নি। সর্বশেষ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ মুহূর্তেই দেশ ছাড়েন সদ্য সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তার ঠিক আগের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
ভারতের সংবাদমাধ্যম 'নর্থ ইস্ট নিউজ ইন্ডিয়া' সম্প্রতি দাবি করেছে, শেখ হাসিনার সরকারের পতনে আওয়ামী লীগের তিন প্রভাবশালী ব্যক্তি রহস্যজনক ভূমিকা পালন করেছিলেন, যা শেষ পর্যন্ত সরকারের পতনে সহায়ক হয়। তারা হলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত। অনেকে মনে করেন, এ তালিকায় আবুল হাসান মাহমুদ আলীও আছেন। তিনি ৫ই আগস্টে সরকারের পতনের আগেই বিদেশে পালিয়ে গেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার পতনের পর যারা পালিয়েছেন তাদের কারো মধ্যেই দেশে অবস্থান করার মতো সৎসাহস ছিল না। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবেই ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করার কারণেই তাদের এ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আবুল হাসান মাহমুদ আলী ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সালেহউদ্দিন আহমেদ
খবরটি শেয়ার করুন