শনিবার, ২রা আগস্ট ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৮ই শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ

*** বরিশালের কোচ হলেন মোহাম্মদ আশরাফুল *** যেভাবে চীনা ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ভারতের অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে পাকিস্তান *** আমেরিকার তুলায় তৈরি পোশাক রপ্তানিতে কিছুটা শুল্ক ছাড় পাবে বাংলাদেশ: বিজিএমইএ *** চুক্তি হয়ে গেলে আমেরিকার অনুমতি সাপেক্ষে গোপনীয়তার বিষয়টি প্রকাশ করা হবে: বাণিজ্য উপদেষ্টা *** বৃত্তি পরীক্ষা আর্থিক প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে *** ৩ বিভাগে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস *** মায়ামির সঙ্গে কী নতুন চুক্তি করবেন মেসি, যা বলছেন কোচ *** ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে *** মাইকেল জ্যাকসনের মোজা বিক্রি হলো ১০ লাখ টাকায় *** ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে ইসরায়েলের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা স্লোভেনিয়ার

রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কাঠামোর ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে পুনর্চিন্তার সময়

উপ-সম্পাদকীয়

🕒 প্রকাশ: ০৮:৩২ অপরাহ্ন, ৬ই এপ্রিল ২০২৫

#

ফাইল ছবি (সংগৃহীত)

মুনওয়ার আলম নির্ঝর

২০০৯ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত পিলখানায় শুরু হওয়া বিদ্রোহ ছিল না শুধুই একটি সহিংস সাময়িক বিস্ফোরণ; বরং এটি ছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কাঠামোর সবচেয়ে দুর্বল অংশগুলোর প্রকাশ্য বিস্ফোরণ। বাংলাদেশ রাইফেলসসের (বিডিআর) অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ, পুঞ্জীভূত বঞ্চনা, নেতৃত্ব সংকট এবং গোয়েন্দা ব্যর্থতার ফলে সেদিন ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জন প্রাণ হারান। 

পিলখানার বিদ্রোহ ছিল এমন এক ধরনের বিপর্যয়, যা একদিকে বেসামরিক-সামরিক সম্পর্কের অসাম্য উন্মোচন করে, অন্যদিকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাঠামোগত অদক্ষতা, সমন্বয়ের অভাব এবং রাজনৈতিক-প্রশাসনিক উদাসীনতাকেও নগ্ন করে দেয়।

বিদ্রোহের পেছনে ছিল দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ। বিডিআরের জওয়ানরা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছিলেন কম বেতন, সীমিত পদোন্নতি, সেনা কর্মকর্তাদের কর্তৃত্ববাদী আচরণ এবং অসম সুযোগ-সুবিধার বিরুদ্ধে। এসব অসন্তোষ বিভিন্ন সময় প্রকাশ পেয়েছিল, এমনকি বিদ্রোহের কয়েকদিন আগেও ‘বিডিআর সপ্তাহ’-এর মতো উৎসবে মুখে মুখে উঠেছিল সেই ক্ষোভের শব্দ। 

কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভেতরে বিদ্যমান বিভাজন—যেমন ডিজিএফআই, এনএসআই এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চের পারস্পরিক অসহযোগিতা এবং তথাকথিত ‘স্টোভপাইপিং’ এ সংকেতগুলোকে যথাযথভাবে বিশ্লেষণ ও প্রয়োগে ব্যর্থ করে তোলে।

দেশে কৌশলগত গোয়েন্দা বিশ্লেষণ এখনো একটি উপেক্ষিত ক্ষেত্র। বাস্তবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আজও মূলত রাজনীতিকেন্দ্রিক, প্রতিপক্ষের গতিবিধি নজরদারির দিকে বেশি মনোযোগ দেয়। কৌশলগত হুমকি যেমন বাহিনীর অভ্যন্তরীণ হতাশা, সাংগঠনিক অপ্রতুলতা, বেতনের বৈষম্য বা সাংস্কৃতিক বৈকল্য—এগুলোকে জাতীয় নিরাপত্তার অন্তর্ভুক্ত বলেই মনে করা হয় না।

পিলখানা বিদ্রোহ বাঙালি রাষ্ট্রচিন্তার আরেকটি গভীর অসংগতি সামনে আনে—প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্বে বেসামঞ্জস্য। বিডিআর একটি আধাসামরিক বাহিনী হয়েও এর নেতৃত্বে ছিল সেনাবাহিনীর প্রেষিত কর্মকর্তা, যারা বাহিনীর সাংস্কৃতিক বাস্তবতা, সদস্যদের মনস্তত্ত্ব বা প্রয়োজনীয় কল্যাণনীতি সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন। একই ব্যারাকে সেনা কর্মকর্তারা জীবনযাপনের দিক থেকে ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন শ্রেণিতে—তাদের জন্য ছিল উন্নত বাসস্থান, রেশন, সুযোগ-সুবিধা, অথচ বিডিআর জওয়ানদের জন্য বরাদ্দ ছিল ন্যূনতম।

এ ধরনের বৈষম্যমূলক কাঠামো যে কোনো আধাসামরিক বাহিনীর মধ্যে আত্মসম্মানহানিকর মনোভাব ও বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয়। এটি কেবল বাহিনীর ঐক্যকে দুর্বল করে না, বরং বৃহত্তর জাতীয় নিরাপত্তা কাঠামোর ভিত্তিকেই নড়বড়ে করে তোলে।

বিদ্রোহের বড় কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল বিডিআরের অভ্যন্তরীণ অভিযোগ ব্যবস্থার অকার্যকারিতা। এমন কোনো সিস্টেম ছিল না, যার মাধ্যমে একজন সাধারণ সদস্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে নিরাপদভাবে অভিযোগ জানাতে পারতেন। বরং অভিযোগ করলে বিপরীতে শাস্তির ভয় ছিল। এর ফলে ক্ষোভের আগুন নিভে না গিয়ে ভেতরে ভেতরে পুঞ্জীভূত হতে থাকে।

অন্যদিকে আমলাতান্ত্রিক স্থবিরতা ও সংস্কারে অনীহার ফলে বহুবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বেতন, পদোন্নতি, আবাসন বা কল্যাণনীতি বদলানোর বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। শাসনব্যবস্থার এ অনুপস্থিতি পিলখানায় রক্তাক্ত পরিণতিতে রূপ নেয়।

সরকার বিদ্রোহের পর একটি বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিডিআরের নাম পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) করে। একটি নতুন আইন প্রণয়ন, আচরণবিধি সংশোধন, বেতন-সুবিধা বৃদ্ধির ঘোষণা এবং জওয়ানদের কল্যাণে কিছু বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হয়। যদিও এগুলো বাহ্যিকভাবে বাহিনীর সংস্কারে সহায়ক হয়, তবুও তা মূল কাঠামোগত সংকটের সমাধান নয়।

গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধির কথাও বলা হয়, কিছু অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও নেওয়া হয়, কিন্তু কোনো ‘জাতীয় গোয়েন্দা সমন্বয় কেন্দ্র’ গঠন করা হয়নি। ফলে গোয়েন্দা ব্যবস্থার মূল সমস্যা বিভাজন, প্রতিযোগিতা, তথ্য গোপনীয়তা ও বিশ্লেষণহীনতা—আজও বহাল তবিয়তে আছে।

সরকার বিডিআর বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত শত শত সদস্যকে বিচারের আওতায় আনে। অনেককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, অনেকের কারাদণ্ড হয়। কিন্তু হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব, বন্দিদের উপর নির্যাতন এবং গণবিচারের মতো আচরণের সমালোচনা করেছে। 

এ প্রশ্ন উঠে এসেছে, এ বিচারপ্রক্রিয়া কি সত্যিকার অর্থে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করল, নাকি রাষ্ট্রের ক্ষত সারানোর চেয়ে প্রতিশোধ পরিপূর্ণ করাই ছিল মুখ্য?

পিলখানা বিদ্রোহ আজকের বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ পুনর্বিবেচনার অনুঘটক হয়ে উঠতে পারে—শুধু বাহিনীর কল্যাণনীতি নয়, বরং পুরো নিরাপত্তা শাসন কাঠামোর। আমাদের দরকার এমন একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যেখানে কেবল বাহ্যিক হুমকি নয়, অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক ভারসাম্যহীনতাও জাতীয় নিরাপত্তার অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে।

আমাদের গোয়েন্দা ব্যবস্থাকে হতে হবে তথ্য সংগ্রহ-নির্ভর নয়, বরং বিশ্লেষণ-নির্ভর। আমাদের নিরাপত্তা নীতিকে হতে হবে অংশগ্রহণমূলক, প্রতিরোধ-নির্ভর, এবং সর্বোপরি দায়বদ্ধতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। 

রাষ্ট্রকে এমন একটি কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যেখানে সৈনিকদেরও ‘নাগরিক’ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয় এবং জওয়ানদের অভিযোগ প্রতিকারের ব্যবস্থা থাকে সেন্সরহীন, শাস্তিমুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক।

পিলখানা বিদ্রোহ ছিল আমাদের রাষ্ট্রীয় অবহেলার এক রক্তাক্ত ফলাফল। কিন্তু সেই ঘটনার মধ্য দিয়েই আমাদের একটি বড় শিক্ষাও পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে—রাষ্ট্র যদি তার নিজের প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতরের বঞ্চনা দেখতে না পায়, তবে একদিন সেই প্রতিষ্ঠানগুলোই হয়তো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেবে। 

পিলখানা যেন শেষ হয় একটি অধ্যায় হিসেবে। নতুন অধ্যায়ের সূচনা হোক একটি ন্যায্য, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নিরাপত্তা শাসনব্যবস্থার মধ্য দিয়ে।

মুনওয়ার আলম নির্ঝর: সেন্টার অফ মিডিয়া এন্ড ইনফরমেশন ওয়ারফেয়ার স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মারা, মালয়েশিয়া।

বিডিআর বিদ্রোহ

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন