ছবি: সংগৃহীত
১৭৮৯ সালের বিপ্লবের পর ফ্রান্সে সংবাদপত্র ও তথ্যপ্রবাহ রাজনৈতিক ক্ষমতার অন্যতম হাতিয়ারে পরিণত হয়। যদিও বিপ্লবীরা তখন ‘প্রেসের স্বাধীনতা’-কে অন্যতম বড় অর্জন হিসেবে প্রচার করেছিলেন, তবে বাস্তবে সাংবাদিকতার কোনো প্রকৃত স্বাধীনতা ছিল না। বরং, ক্ষমতাসীনরা সংবাদপত্রকে দমন ও নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন।
ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারউইকের ইতিহাসবিদ চার্লস ওয়ালটন তার পোলিসিং পাবলিক অপিনিয়ন ইন দ্য ফ্রেঞ্চ রেভল্যুশন (Policing Public Opinion in the French Revolution) গ্রন্থে লিখেছেন, বিপ্লবী সরকার শুধু দমনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; তারা দেশজুড়ে এজেন্টদের এক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল, যারা জনমত পর্যবেক্ষণ ও বিপ্লবী প্রচারণা চালাত।
১৭৯৯ সালের ১৮ই নভেম্বর ব্রুমেয়ারের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে প্রেসের ওপর জ্যাকোবিনদের কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার করেন নেপোলিয়ন। উল্লেখ্য, জ্যাকোবিনরা ছিল বিপ্লবীদের সেই অংশ, যারা চরমপন্থী পদক্ষেপে বিশ্বাস করত এবং পুরোনো শাসনব্যবস্থার সবকিছু সম্পূর্ণ ধ্বংস করে নতুন ফরাসি প্রজাতন্ত্র গড়তে চেয়েছিল।
১৮০০ সালের জানুয়ারিতেই নেপোলিয়ন একটি ডিক্রি জারি করে ৫০টি রাজনৈতিক সংবাদপত্র বন্ধ করেন। প্যারিসে টিকে থাকে মাত্র ১৩টি, আর নতুন কোনো সংবাদপত্র চালুর অনুমতি পুরোপুরি নিষিদ্ধ হয়। তিনি জোসেফ ফুশেকে পুলিশের মন্ত্রী নিযুক্ত করে প্রেসের ওপর নজরদারির দায়িত্ব দেন।
ফুশের কার্যালয় শুধু সংবাদপত্রই নয়, নাটক, পুস্তিকা ও পোস্টার প্রকাশের অনুমতিও নিয়ন্ত্রণ করত। প্রতিটি অঞ্চলের প্রশাসকদের নিয়মিতভাবে জনমতের প্রতিবেদন জমা দিতে হতো। নেপোলিয়নের দাবি ছিল—জাতীয় স্বার্থে এ দমননীতির প্রয়োজন রয়েছে। ১৮০৩ সালে তিনি ঘোষণা দেন, ‘ফরাসি জাতিই এমন যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সীমিত এবং কঠোর পুলিশি তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে।’
নেপোলিয়ন বিশেষ করে ইংরেজি সংবাদপত্র নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। ১৮০২ সালে তিনি নির্দেশ দেন, কোনো ইংরেজি সংবাদপত্র ফ্রান্সে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। ইতিহাসবিদ অস্কার কক্স জেনসেন উল্লেখ করেছেন, ইংরেজি ভাষার প্রকাশনায় নেপোলিয়নের মতো এত আলোচিত চরিত্র আর কেউ ছিলেন না।
১৮০৩ সালে আরেক ডিক্রিতে ফ্রান্সে বিক্রির জন্য রাখা প্রতিটি বই আগে পর্যালোচনা কমিশনে জমা দেওয়ার নিয়ম চালু হয়। পরে এ দায়িত্ব সরাসরি ফুশের মন্ত্রণালয়ের হাতে যায়।
নেপোলিয়ন তার সাফল্য প্রচারে সংবাদপত্র ও কার্টুনকে ব্যবহার করতেন। তিনি ফুশেকে বিভ্রান্তিকর সংবাদ ছড়াতে নির্দেশ দিতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এমনকি কখনো কখনো সামরিক জয়ের মনগড়া খবর প্রকাশ করতেও নাকি বলা হতো। কুঁরিয়ে দে ল’আর্মে ডি’ইতালি ও লা ফ্রঁস ভ্যু দে ল’আর্মে ডি’ইতালি—তার বিজয়ের প্রচারণায় মুখ্য ভূমিকা রাখার জন্য আলোচিত দুটি সামরিক পত্রিকা।
১৮০৬ সালের পর তিনি ধর্মীয় প্রকাশনাকেও সীমাবদ্ধ করেন। অনুমতি দেওয়া হয় কেবল লা জ্যুর্নাল দে কুঁরে নামের একটি পত্রিকাকে। স্বাধীন জ্যুর্নাল দে দেবা পরিবর্তিত হয়ে সরকারের মুখপত্র জ্যুর্নাল দে ল’এম্পায়ার-এ পরিণত হয়।
১৮১১ সালে নেপোলিয়ন প্যারিসে মাত্র চারটি এবং প্রতিটি অঞ্চলে একটি করে সংবাদপত্র রাখার অনুমতি দেন। এগুলো ছিল কার্যত সরকারের প্রচারযন্ত্র। তবুও সেন্সরশিপ রাশিয়ায় তার বিপর্যয়কর অভিযানের খবর ঠেকাতে পারেনি। ১৮১৪ সালে প্রুশিয়া ও অস্ট্রিয়ার আক্রমণের মুখে নেপোলিয়ন ক্ষমতা হারান।
নেপোলিয়নের পতনের পর পুনর্বহাল হওয়া বুরবন রাজতন্ত্র ১৮১৯ সালে ‘সেরে আইন’ পাস করে, যা প্রথমবারের মতো ফ্রান্সে সংবাদপত্রকে সত্যিকারের স্বাধীনতা দেয় বলে মনে করেন অনেকে।
জে.এস/
খবরটি শেয়ার করুন