ছবি: সংগৃহীত
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে একটা পর্যায় থেকে দেশে ছাপা পত্রিকার পাঠক আশঙ্কাজনক হারে কমে যায়। অনলাইনের দাপটের পাশাপাশি পত্রিকাগুলোতে 'একই ধরনের লেখার' অভিযোগে পাঠক কমে যায় বলে মনে করেন গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা। বেশিরভাগ পত্রিকা তখন সরকারের 'প্রশংসায় ভরপুর' থাকত বলে পাঠকরা মুখ ফিরিয়ে নেন।
বিক্রিতে তখন ধ্বস নামে ঢাকা থেকে প্রকাশিত অধিকাংশ জাতীয় দৈনিকের। এর আগেই সাপ্তাহিক পত্রিকার যুগ হারিয়ে যায়। এরপর পত্রিকা শিল্পে আরেকটা ধাক্কা আসে করোনাভাইরাস বাংলাদেশসহ প্রায় পুরো বিশ্বে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লে। করোনা মহামারির সময় ছাপা পত্রিকার প্রচারসংখ্যা এক ধাক্কায় অনেক কমে আসে। করোনা–পরবর্তী সময়ে আবার ছাপা পত্রিকার প্রচার বাড়লেও করোনার আগের অবস্থায় আর ফিরে যেতে পারেনি।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে পত্রিকার পাঠক কিছুটা বাড়ে। যদিও অভিযোগ আছে, অধিকাংশ পত্রিকা তখন পাঠক ও জনগণের মনোভাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ওই বছরের ৫ই আগস্টে আওয়ামী লীগের সরকারের পতন ঘটলে পত্রিকার বিক্রি আবার বাড়ে।
জাতীয় অনেক পত্রিকার সাংবাদিকতায় তখন পরিবর্তন আসে। উপস্থাপনায় আসে বৈচিত্র্য। পাঠকরা মুক্তি পান একঘেঁয়েমিতে ঠাসা অবস্থা থেকে। অনেকে আশাবাদী হয়ে ওঠেন, দেশে মুক্ত সাংবাদিকতার চর্চা শুরু হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজনৈতিক আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে, পরিবর্তন আসন্ন ও প্রত্যাশিত হয়ে উঠলে, বা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় সাধারণত পত্রিকার বিক্রি বাড়ে।
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের আগে-পরে দেশের পত্রিকাগুলোর কাটতি যেভাবে বাড়ে, তা পত্রিকাগুলো ধরে রাখতে পারেনি। গতানুগতিক সাংবাদিকতা, একই ধারার বর্ণনা ও পরিচিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিদিনের একঘেঁয়ে বক্তব্য ছাপানো ইত্যাদি কারণে গত তিন-চার মাস ধরে পাঠক ক্রমেই কমছে। নতুন চিন্তা না থাকা, কোথাও কোথাও মেধা চর্চার ও দাপুটে প্রতিদ্বন্দ্বী অনলাইনে যুগে তাল মিলিয়ে চলার যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে পত্রিকার বাজার ছোট হয়ে আসছে।
কিন্তু আশ্চর্যজনক হচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতেও সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর (ডিএফপি) দাবি করছে, প্রতিদিন সব মিলিয়ে দেশে ১ কোটি ৮৫ লাখ কপির বেশি পত্রিকা ছাপা হচ্ছে! অর্থাৎ প্রতি ৯ জনের বিপরীতে এক কপি পত্রিকা ছাপা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, ১৭ কোটি মানুষের এ দেশে প্রতিদিন কী সত্যিই এতো সংখ্যায় পত্রিকা ছাপানো হয়? কোন কোন পত্রিকা মিলে পৌনে দুই কোটি কপি ছাপায়? কোথায় ছাপা হয় পত্রিকাগুলো? এতো পত্রিকা কারা পড়েন?
নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (নোয়াব) সভাপতি এ কে আজাদ এ প্রসঙ্গে বলেন, 'এখন সংবাদপত্রশিল্পে আবার কিছু নতুন হুমকি দেখা দিয়েছে। সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা কমছে, আয় কমছে। মূল্যস্ফীতির কারণে খরচ বাড়ছে।' 'সংবাদপত্রশিল্পকে নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর ও করপোরেট কর এ শিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে।'
ডিএফপির সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, এখন দেশে শুধু মিডিয়া তালিকাভুক্ত দৈনিক পত্রিকা আছে ৫৮৪টি। এর মধ্যে ২৮৪টি ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। ডিএফপির গত আগস্ট মাসে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ২৮৪টি সংবাদপত্রের ১ কোটি ৫৩ লাখ ৮৬ হাজার কপি ছাপা হচ্ছে। খোঁজ নিলে জানা যায়, এসব পত্রিকার বেশিরভাগেরই নাম পাঠকরা কখনো শোনেননি। বাজারে নামসর্বস্ব এসব পত্রিকা খুঁজে পাওয়াটাও অনেকটা দুঃসাধ্য সাধনের মতো। কিছু পত্রিকার দেখা পাওয়া যায় শুধু রাজধানীর কিছু দেয়ালে।
দেশে প্রকাশিত সংবাদপত্র ও সাময়িকীর মিডিয়া তালিকাভুক্তি, নিরীক্ষা এবং প্রচারসংখ্যা নির্ধারণ করে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ডিএফপি। মিডিয়া তালিকাভুক্তি বলতে সরকারের তালিকাভুক্ত সংবাদপত্র হিসেবে স্বীকৃত হওয়া এবং সরকারি ও আধা সরকারি সংস্থাগুলোর বিজ্ঞাপন প্রচারের যোগ্যতা অর্জন করাকে বোঝায়। বেশিরভাগ পত্রিকার মিডিয়া তালিকাভুক্তি ও প্রচারসংখ্যা নির্ধারণে বড় ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়। এর সঙ্গে জড়িত ডিএফপির কিছু অসাধু কর্মচারী। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপও কাজ করে।
ডিএফপি যেসব পত্রিকার তালিকা দিয়ে প্রতিদিন ১ কোটি ৮৫ লাখ কপি ছাপা হওয়ার দাবি করছে, সেগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ পত্রিকা নিয়মিত ছাপা হয় না। কিছু পত্রিকা ঢাকার দেয়ালে মাঝেমধ্যে দেখা যায়। আর কিছু পত্রিকা বের হয় সরকারি বিজ্ঞাপন বা ক্রোড়পত্র পেলে। যখন যে প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দেয়, সে প্রতিষ্ঠানে ও সরকারি কিছু দপ্তরে এসব পত্রিকার কপি পৌঁছে দেওয়া হয় নিজেদের উদ্যোগে।
কিছু পত্রিকা হাতেগোনা কয়েক কপি ছাপা হয়, যেগুলো কিছু নির্দিষ্ট সরকারি দপ্তর ও যাদের নিয়ে বিশেষ সংবাদ করা হয়, তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। এ পত্রিকাগুলো ‘দেয়াল পেস্টিং’ পত্রিকা ও ‘আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা’ হিসেবে পরিচিত।
সুখবর ডটকমের অনুসন্ধান বলছে, পাঠকের কাছে পত্রিকা পৌঁছে দেওয়ার প্রধান মাধ্যম হকার। ঢাকা মহানগর ও এর আশপাশের (সাভার, নবীনগর, সিঙ্গাইর, গাজীপুর, দাউদকান্দি, মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত) এলাকায় সংবাদপত্র বিলি করে থাকে হকারদের দুটি সংগঠন। এর একটি ঢাকা সংবাদপত্র হকার্স বহুমুখী সমবায় সমিতি। আরেকটি হলো সংবাদপত্র হকার্স কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি। সমিতি দুটির নেতারা জানিয়েছেন, এ দুই সমিতির বাইরে আর কেউ ঢাকা মহানগরে সংবাদপত্র বিলি করেন না।
এ দুই সমিতি যেসব পত্রিকা বিলি করে, সেটার নির্দিষ্ট তালিকা আছে। তালিকা দুটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হকার্স কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি যে ৪৪টি পত্রিকা বিলি করে, ঢাকা সংবাদপত্র হকার্স বহুমুখী সমিতির তালিকায়ও এর ৪২টি আছে। অর্থাৎ এ দুটি সমিতি ঢাকায় বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে মোট ৫৪টি দৈনিক সংবাদপত্র বিক্রি করে। সব মিলে প্রতিদিন গড়ে সোয়া চার লাখ কপি পত্রিকা বিক্রি হয়। প্রশ্ন আসে, ডিএফপির দাবি অনুযায়ী প্রতিদিন ছাপা হওয়া ১ কোটি ৮৫ লাখ কপি পত্রিকা বিলি করেন কারা?
এইচ.এস/
খবরটি শেয়ার করুন