কারাবন্দী সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু, শ্যামল দত্ত, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি শাহরিয়ার কবির। ছবি: সংগৃহীত
সাংবাদিক জ. ই. মামুন ও আশিস সৈকত তখন বেসরকারি দুটি টিভি চ্যানেল যথাক্রমে এটিএন বাংলা এবং ইনডিপেনডেন্টের শীর্ষ দায়িত্বে। ২০১৮ সালের ১১ই জানুয়ারি ঢাকার পিআইবির মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দু'জনই আমন্ত্রিত আলোচক ছিলেন। এতে এটিএন বাংলার তখনের প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জ. ই. মামুন বলেন, ‘গণমাধ্যমের ওপর মালিক, বিজ্ঞাপনপক্ষ ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থার চাপ আছে। এসব কারণে দেশে জনমুখী সাংবাদিকতা হচ্ছে না। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে কোনো সংবাদ ছাপা হবে কী হবে না, তা নিয়ে চাপ দেওয়া হচ্ছে।’
ইনডিপেনডেন্ট টিভির ওই সময়ের প্রধান বার্তা সম্পাদক আশিস সৈকত বলেন, 'বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের পরও দেশের কয়েকজন সম্পাদককে একটি গোয়েন্দা সংস্থা থেকে ডেকে নেওয়া হয়েছে। ওই সংবাদের একটি প্রতিবাদলিপি ধরিয়ে দিয়ে সাংবাদিকদের কোনো মন্তব্য ছাড়াই তা প্রকাশ করতে বাধ্য করা হয়েছে।' ঠিক কতজন সম্পাদককে ওই সময় গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই ডেকে নিয়ে কথিত প্রতিবাদলিপি ধরিয়ে দেন, এর সঠিক সংখ্যা আশিষ সৈকত অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে উল্লেখ করেননি।
সুখবর ডটকমের অনুসন্ধান বলছে, জাতীয় চারটি দৈনিক পত্রিকার চারজন সম্পাদককে ডিজিএফআই তখন ডেকে নেয়। যে সংবাদের ভিত্তিতে তাদের ডেকে নেওয়া হয় ডিজিএফআইয়ের কার্যালয়ে, তা ছিল আওয়ামী লীগের সরকারের প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রতিবেদন।পিআইবিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে জ. ই. মামুন ও আশিস সৈকতের বক্তব্যে সেই সময়ের সাংবাদিকতায় গোয়েন্দা সংস্থার চাপ, মালিকপক্ষের হস্তক্ষেপের পাশাপাশি অনেক সাংবাদিকের 'জনমুখী ও মুক্ত সাংবাদিকতার' দাবি বর্ণিত হয়েছে।
তবে তারা নানা কারণে আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে প্রত্যাশিত জনমুখী সাংবাদিকতা ঠিকমতো করতে পারেননি বলে অভিযোগ আছে। বিএনপি-জামায়াতের সমর্থিত ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা, জাতীয় প্রেসক্লাবের শীর্ষ দায়িত্ব পালনকারী এক সাংবাদিকসহ অনেক সাংবাদিক এখন কাজ করছেন ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের মালিকানাধীন দৈনিক কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ডেইলি সান, বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর, নিউজ টোয়েন্টিফোর চ্যানেল, টি-স্পোর্টস ও ক্যাপিটাল এফএম রেডিওতে। গত মাস খানেক ধরে হঠাৎ করে ইস্ট ওয়েস্ট গ্রুপের প্রচারমাধ্যমগুলো 'অতি সরকারবিরোধী'।
এসব প্রচারমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, উপদেষ্টা পরিষদের কোনো না কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনামূলক একাধিক বিশেষ লেখা, কলাম ও মন্তব্য প্রতিবেদন থাকে। ওই সংবাদমাধ্যমগুলোতে কর্মরত বিএনপি-জামায়াতের প্রতি 'সহানুভূতিশীল' অন্তত চারজন সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুখবরকে বলেন, 'পেশাদারত্বের জায়গা থেকে তারা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করতে চান। তবে ইস্ট ওয়েস্ট গ্রুপের আকস্মিক অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার নীতিমালা নির্ধারণে সাংবাদিকদের কোনো ভূমিকা নেই। এ বিষয়ে মালিকপক্ষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।'
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের মতো দেশগুলো, যেখানে শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণমাধ্যমগুলো প্রতিষ্ঠা পায়নি, সেসব দেশে গণমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতিমালা নির্ধারণে সাংবাদিকদের ভূমিকা রাখার সুযোগ সাধারণত থাকে না। মালিকের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশই সাংবাদিকদের জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে 'চূড়ান্ত স্বাধীনতা'। আওয়ামী লীগের আমলে শীর্ষ দায়িত্বে থাকা অনেক সাংবাদিক চাইলেও যেমন মালিকপক্ষসহ নানা চাপে স্বাধীন সাংবাদিকতা সবসময় করতে পারেননি, বর্তমানেও তা অনেকে করতে পারছেন না ঘুরেফিরে প্রায় একই কারণে। মালিকপক্ষের চাপে গত ৫ই আগস্টের পর থেকে আগের নীতিমালা বিসর্জন দিয়ে সাংবাদিকতার নামে যাচ্ছেতাই ছাপছে দৈনিক জনকণ্ঠ, যুগান্তরের মতো পত্রিকাগুলো।
অবশ্য চারদিনের সফরে লন্ডন অবস্থানরত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ব্রিটেনের নীতিগবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউজের রয়্যাল ইন্সটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের আয়োজিত সংলাপে গত বুধবার (১১ই জুন) বর্তমান সরকারের সময় মিডিয়ায় ক্রাকডাউনের (সংবাদমাধ্যমের ওপর বল প্রয়োগ) অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি দাবি করেন, 'তার সরকারের সময়েই সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে সংবাদমাধ্যম, যা আগে কখনো হয়নি।' যদিও বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞরা এমন বাস্তবতা দেখছেন না।
ভারতীয় এক লোকসভা নির্বাচন, ওই নির্বাচনেই নরেন্দ্র মোদি প্রথম দেশটির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হন। ভারতের প্রভাবশালী একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার মালিকের নির্দেশ ছিল- বিজেপির নেতৃত্বের জোটের নির্বাচনী প্রচারণার খবর মোদির ছবিসহ তার পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপাতে। দেশটির সাংবাদিক সিদ্ধার্থ ভরদরাজন তখন ওই পত্রিকার শীর্ষ পদের দায়িত্বে। তার যুক্তি ছিল- মোদির মতো উগ্র গেরুয়াবাদী রাজনীতিকের ছবি প্রগতিশীল নীতিমালায় বিশ্বাসী কোনো পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপানো যায় না। মালিকের নির্দেশ মতে মোদির ছবি ঠিকই পত্রিকাটির প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয় আর চাকরি ছাড়তে হয় সিদ্ধার্থকে।
বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলোতে সাংবাদিকদের জন্য যেখানে এমন বাস্তবতা বিদ্যমান, সেখানে গত বছরের ৫ই আগস্টের পর আওয়ামী লীগের প্রতি 'সহানুভূতিশীল' সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে 'ফ্যাসিস্টের সহযোগী' অ্যাখ্যা দিয়ে চাকরিচ্যুত করা, তাদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণহীন 'হত্যা মামলা' দায়ের করার ঘটনাগুলো শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। এ রকম ভিত্তিহীন মামলায় ১৩ সাংবাদিককে মাসের পর মাস ধরে সরকার কারাবন্দী করে রেখেছে। ২৬৬ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে 'হত্যা মামলা' দায়ের হয়েছে। এত সংখ্যক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের এবং প্রমাণ ছাড়া ১৩ জন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিককে কারাবন্দী করে রাখার বিষয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার ইতিমধ্যে 'বিশ্বরেকর্ড' গড়েছে। এ রকম উদাহরণ কোনো দেশের গণতান্ত্রিক, এমনকি অগণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও বিরল।
দৈনিক প্রথম আলো মনে করছে, 'ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের সময় সহিংসতার অভিযোগে আওয়ামী লীগপন্থী হিসেবে পরিচিত অনেকে (সাংবাদিক) দীর্ঘদিন ধরে প্রমাণ ছাড়া আটক রয়েছেন। এ ধরনের আটক ও জামিন না পাওয়ায় বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও সরকারের সংস্কার প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।'
সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান, বহু বছর ধরে আইসিটির বিচার কার্যক্রম ও বাংলাদেশ নিয়ে লিখছেন। তিনি বলছেন, 'গ্রেপ্তার ও মামলা হওয়া কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ অবশ্যই থাকতে পারে। আওয়ামী লীগ শাসনামলে তারা এমন এক সরকারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যে সরকার বিরোধী দল দমন করেছে, নির্বাচনে জালিয়াতি করেছে, গুম করেছে, সংবাদমাধ্যমকে চুপ করিয়ে রেখেছে ও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে অন্যায়ভাবে মানুষকে আটক রেখেছে। তবু রাজনৈতিক আনুগত্য কিংবা কোনো কর্তৃত্ববাদী শাসনের কট্টর সমর্থক বা প্রচারক হওয়াটাই অপরাধ নয়।'
তিনি বলেন, 'এটা ঠিক যে সাংবাদিক, সম্পাদক শাকিল আহমেদ ও মোজাম্মেল বাবু গত ২৩শে জুলাই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এডিটরস গিল্ডের এক বৈঠকে আন্দোলনকারীদের নিয়ে উসকানিমূলক মন্তব্য করেছেন, এমন রেকর্ডও রয়েছে। এ ধরনের বক্তব্যের কিছু অংশ ধাক্কা খাওয়ার মতো ছিল।' তিনি বলেন, 'এসব বক্তব্যের কোনো অংশেই দেখা যায় না যে, তারা কেউ আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন বা তা সমর্থন করেছেন। আরও স্পষ্ট করে বললে, তাদের আটক রাখার যে নির্দিষ্ট অভিযোগ, সেই অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ এসব রেকর্ডে নেই।'
কারাবন্দী সাংবাদিকদের একটি নির্দিষ্ট গোলাগুলির ঘটনায় হত্যা বা হত্যাচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে উল্লেখ করে ডেভিড বার্গম্যান বলেন, 'এ অভিযোগের পক্ষে তাদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে, এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। তাদের গ্রেপ্তারের ভিত্তি হচ্ছে, ওই সময় আহত বা নিহত ব্যক্তিদের স্বজনের দায়ের করা এফআইআর (প্রথম তথ্য প্রতিবেদন)।' তিনি বলেন, 'এ এফআইআরে অভিযোগ তোলা হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা বা ওই গোলাগুলির জন্য অর্থ জোগান দেওয়া কিংবা তা উসকে দেওয়ার কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি।'
তিনি বলেন, 'পুলিশ গ্রেপ্তারের আগে কোনো ধরনের তদন্তের চেষ্টা পর্যন্ত করেনি। দীর্ঘ কয়েক মাস আটক রাখার পরও এখন পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ আদালতে এমন কোনো নতুন প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি, যা এ নির্দিষ্ট অভিযোগগুলোর সঙ্গে তাদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে।' গ্রেপ্তার নিয়ে 'এক ধরনের বাণিজ্য চলছে এবং হয়রানির শিকার হচ্ছেন অনেকে' উল্লেখ করে বার্গম্যান বলেন, 'বিচারব্যবস্থা যেন এমন সব মানুষকে দীর্ঘদিন কারাগারে পড়ে থাকতে দিতে অস্বস্তি বোধ করছে না। এসব মামলায় গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যারা বয়োবৃদ্ধ এবং গুরুতর অসুস্থ, তারাও জামিন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।'
তিনি বলেন, 'অনেকেই আশা করেছিলেন যে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিস্তার লাভ করা যথেচ্ছ ও অন্যায় আটক রাখার সংস্কৃতি তাদের পতনের মধ্য দিয়ে এর অবসান ঘটবে। কিন্তু এর বদলে দেখা যাচ্ছে, নতুন সরকার মুখে সংস্কারের যতই বুলি আওড়াক, এ পুরোনো দমনমূলক চর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে চায় না কিংবা হয়তো পারছে না।'
এইচ.এস/
খবরটি শেয়ার করুন