ছবি - সংগৃহীত
উন্নত দেশগুলোতে কারিগরি শিক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। সে কারণে সেসব দেশে বেকারত্বের হার খুবই কম। বাংলাদেশের শিক্ষাবিদরাও বেকারত্ব দূরীকরণে উন্নত দেশের আদলে দেশের কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দিয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে। দেশে এখন প্রতি তিনজন বেকারের মধ্যে একজন উচ্চশিক্ষিত। তারা বিএ কিংবা এমএ ডিগ্রি নিয়েও চাকরি পাচ্ছেন না। বিগত পাঁচ বছরে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। দিন যত যাবে এই সংখ্যা বেড়েই যাবে। এর মূলে রয়েছে মানসম্মত শিক্ষার অভাব।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া জাপান ও জার্মানির বিস্ময়কর উন্নতির প্রধান কারণ হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা। আজ বিশ্ব অর্থনীতিতে জাপান তৃতীয় ও জার্মানি পঞ্চম শক্তি। কারিগরি শিক্ষার হার জাপানে ৭৩ শতাংশ ও জার্মানিতে ৭১ শতাংশ। শিক্ষার কারিকুলামও আধুনিক তথা চাহিদা মাফিক এবং মান খুবই উন্নত। চীন, মালয়েশিয়া, সিংগাপুর, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়নের মূলে কারিগরি শিক্ষা। সেই অবস্থান থেকে বাংলাদেশ এখনো অনেক দূরে আছে।
দেশের কারিগরি শিক্ষা শিক্ষক সংকট, উপকরণের অভাব, অনুন্নত কারিকুলামসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আছে। বিপুল জনশক্তিকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে কারিগরি শিক্ষায় বিশেষ জোর দিলেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন হয়নি। সরকার ২০১২ সালে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল, ২০২০ সালের মধ্যে কারিগরি শিক্ষার্থী ২০ শতাংশে নিয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো ২০২৪ সালে কারিগরি শিক্ষার্থী মাত্র ১৬ শতাংশে পৌঁছেছে। তবে আন্তর্জাতিক কারিগরি শিক্ষার সংজ্ঞা ও বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় এটি মূলত ৯ শতাংশ। অর্থাৎ এক যুগেও লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও অর্জিত হয়নি।
মানসম্মত শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব এই সংকটের মূলে রয়েছে। বিভিন্ন পলিটেকনিক, মনোটেকনিক এবং কারিগরি স্কুল ও কলেজে শিক্ষক পদের ৭০ শতাংশই শূন্য আছে। এছাড়া জনশক্তি ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান ব্যুরোর অধীন কারিগরি প্রতিষ্ঠানেও প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষক পদ শূন্য আছে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে এক শিফটের শিক্ষক দিয়ে চালানো হচ্ছে দুই শিফট। অনেক প্রতিষ্ঠানে ল্যাবরেটরি সংকট। আবার ল্যাব থাকলেও নেই যন্ত্রপাতি। দেশে সাধারণ সরকারি-বেসরকারি কলেজের সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। অন্যদিকে সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সংখ্যা মাত্র ৪৯। আর ৪৬১টি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থাকলেও ভালো মানের রয়েছে মাত্র ২৫ থেকে ৩০টি। ফলে বেশির ভাগ বেসরকারি পলিটেকনিকে আসন শূন্য থাকে।
সরকারি ও বেসরকারি খাতে কারিগরি শিক্ষার যথেষ্ট সম্প্রসারণ হয়েছে। বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ছোট বড় সরকারি-বেসরকারি ট্রেনিং সেন্টার, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পনের লাখের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। পাঁচ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এই স্তরে শিক্ষার্থী বাড়ছে। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে কারিগরি শিক্ষার হার ৩০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতে চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো হয়। এ ছাড়া বিএম, ভোকেশনাল, কৃষি ডিপ্লোমা রয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, যারা এসব কোর্স করছে, তাদের সহজেই কর্মসংস্থান হচ্ছে। প্রত্যাশা অনুযায়ী চাকরি পাওয়া না গেলেও কাউকে আর বেকার থাকতে হচ্ছে না।
কারিগরি শিক্ষা হলো হাতে কলমে শিক্ষা। এই শিক্ষা যেন সার্টিফিকেট নির্ভর না হয় সেদিকে সরকারকে মনিটরিং করতে হবে। এখনো অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আছে যারা পড়ালেখার চেয়ে সার্টিফিকেটকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সার্টিফিকেট অর্জন করলেও বাস্তবে কোনো ফল বয়ে আনবে না।
তরুণদের কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থানে কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই। তাছাড়া বৈদেশিক কর্মসংস্থানে বেশি বেতনে চাকরির জন্যও কারিগরি শিক্ষা প্রয়োজন। দেশের সার্বিক উন্নয়নে কারিগরি শিক্ষাকে অর্থবহ করার জন্য কারিগরি শিক্ষার আরও সম্প্রসারণ এবং মানসম্মত কারিগরি শিক্ষা নিশ্চিত করা দরকার। আর মানসম্মত কারিগরি শিক্ষাই পারে বেকার সমস্যা দূর করতে।
আই.কে.জে/