মাহবুব কামাল। ছবি: লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া
মাহবুব কামাল
বিভুদার জন্য শোকগুলো যখন পুঞ্জপুঞ্জ মেঘ হয়ে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে, সেখান থেকে এক টুকরো মেঘ অশ্রু হয়ে বৃষ্টির আকারে ভিজিয়ে দিয়ে গেল আমাকে। এই অশ্রুর নাম মিনার মাহমুদ। সেই একই অবহেলা, সেই একই অবজ্ঞা, সেই প্রায় একই সুইসাইড নোট। মিনারও অন্তত আমাকে সব কথা না বলেই অভিমানকে আত্মহননের রূপ দিয়েছিলেন। যদি খুলে বলতেন সব, তাকে বলতাম, এ কোনো সংকট নয়, এ হলো পরিস্থিতি। সংকট কাটানো যায় না, পরিস্থিতি পাল্টানো যায় খুব।
মিনারকেও অবহেলা সইতে হয়েছিল। অবহেলাই বুঝি একমাত্র দুঃখানুভূতি, যা মানুষের ভেতরটাকে ভেঙে দেয়। এ এক নীরব মহাশব্দ, এক অব্যক্ত আর্তনাদ, যা কেবলই হৃদয় মোচড়াতে থাকে। বিভুদা ও মিনার, দু’জনই জীবনের শেষ দিকে যেদিকেই তাকাতেন, দেখতেন বুঝি, ‘দুঃখ তার লেখে নাম’। আমি জানি, কোনো ভালোবাসাই এত শক্ত নয় যে, তা কোনোদিন ভেঙে যাবে না; কিন্তু এ দু’জনের প্রতি মানুষের ভালোবাসা এতটা ভঙ্গুর ছিল, ভেঙে গিয়ে জোড়া লাগানোর জন্য আত্মহত্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। কে জানে এ কী ধরনের নিয়ম।
’৮০ সালে যখন রাজনীতি ছেড়ে দিলাম, তারও অনেকদিন পর পর্যন্ত হলেই ছিলাম। এরপর শাহ কামাল ভাইয়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি। আমি স্কলাসটিকায় চাকরি নিলাম, কামাল ভাই তার প্রেমিকা নাজলিকে নিয়ে ব্যস্ত। আমি বিবাহিত ছিলাম বলে আমার প্রেমিকা নেই, আছে অফুরন্ত বান্ধবী।
অথচ প্রেমিকাই রোমাঞ্চকর, স্ত্রী সঙ্গিনীমাত্র। প্রেমিকা মানে সার্বক্ষণিক অকুপেশন, আমার প্রেমিকা নেই, তাই অবসরও অনেক। পাটগ্রাম যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই সময়টায় মিনারসহ বেশ কয়েক অফ-ট্র্যাকে কথা বলা মেধাবীর সঙ্গলাভ করি আমি। রুদ্রের (রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ) সঙ্গে দু’একবারই হাই-হ্যালো হয়েছে শুধু, তবে শুনেছি আমাকে নাকি খুব পছন্দ করতো সে।
যাদের কথা বলছি, তারা বয়সে আমার চেয়ে সামান্য ছোটই হবে; কিন্তু কী হাকিম চত্বর, অথবা কখনো কখনো শাহবাগের রেখায়ন, তাদের কারও না কারও সঙ্গে দেখা হলেই জীবনের বিরাজনীতিকরণ হয়ে যেত। সেখানে জায়গা নিত বালজাক, বোদলেয়ার অথবা মপাসাঁ। শাহবাগের সিনোরিটার আড্ডাটা ছিল অবশ্য সমবয়সীদের।
যাদের কথা বলছি, সবক্ষেত্রে যেমন কথা বলা মানে নিছকই যোগাযোগ স্থাপন, তাদের বেলায় তেমনটা নয়। তাদের কথা মানে তা তির্যক, জীবনের অন্য ঢং। আমরা যে জীবনপ্রবাহ দেখি সমাজে, সেটা যদি ঘাসের ভূমি হয়, তাহলে তারা ঘাসফুল। আমাদের মধ্যে রাজার কথা যদি বলি, যে কিনা কালের কণ্ঠে’র সম্পাদক হাসান হাফিজের বড় ভাই, তিনি ছিলেন আমাদের কাছে মার্ক টোয়াইনের অতিরিক্ত কিছু। মার্ক টোয়াইন অশ্লীলতা না করেই পেটে খিল ধরিয়ে দেন, আর রাজা যদি বা কখনো অশ্লীল কথা বলতেন, সেটা হয়ে যেত শিল্প।
তিনি নামেই শুধু রাজা নন, চার্লি চ্যাপলিন অথবা ভারতের জেসপাই ভাট্টির মতো কিং অফ কমেডি। সিনোরিটার অন্যতম অংশীজন আমেরিকাপ্রবাসী নাসির ভাইয়ের সঙ্গে এখনো কথা হলে হাসার জন্য আমরা রাজাকেই বেছে নেই। যাই হোক, মিনারের ‘বিচিন্তা’ যখন নিষিদ্ধ গন্দম সাপ্তাহিক যায়যায়দিনের বিকল্প হয়ে পাঠককে অন্য স্বাদে মাতাচ্ছে, আমি তখন পাটগ্রামে স্কুল চালাই। বিচিন্তার সম্পাদকীয়র মতো তির্যক সম্পাদকীয় আমি আর পড়তে পারিনি। শুধু সম্পাদকীয় কেন, এ সাপ্তাহিকের ছত্রে ছত্রে ছিল হুল ফোটানো যত শব্দ।
সেই সময়টায় বিটিভিতে প্রতি মঙ্গলবার একটি সিরিয়াল প্রচারিত হতো। পত্রিকাটি লিখেছিল, এই মাঙ্গলিক অত্যাচার আর কতোদিন সহ্য করতে হবে? সুবল বনিক একবার লিখলেন, বিটিভিতে একজন নতুন নায়ক বেরিয়েছেন, আরেব্বাবা!
’৯০ সালের বইমেলা উপলক্ষে কিছুদিনের জন্য পাটগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিলাম যখন, বিচিন্তার কাকরাইল অফিসে মিনারের সঙ্গে একথা-সেকথা। তার কলাম ‘মনে পড়ে রূবি রায়’-এর এক জায়গায় একটা ভুল তথ্য ছিল, সংশোধন করে দিয়েছিলাম সেটাও।
’৯৯ সালে আমি যখন নিই ইয়র্কে যাই, তখন মিনার ও সলিমুল্লাহ খান থাকতেন এই শহরেই। খান সাহেব মাস্টারি করেন আর মিনার চালাতেন ক্যাব। নিউ ইয়র্কে এসেছি, অথচ এ দু’জনের সঙ্গে দেখা, অন্তত ফোনে কথা না হলে যে আমার জীবন তুচ্ছ হয়ে যায়। মিনার তার ক্যাবেই আমাকে নিয়ে যান হাডসন নদীর তীরে। এবার আমরা যুৎ হয়ে বসি। আর অমনি ‘চঞ্চল মন আনমনা হয়, যেই তার ছোঁয়া লাগে।’
তখন ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। তাকে বলেছিলাম, অথচ নির্বাসনে আপনারা দু’জনই। মিনারের নির্বাসনকেও forced exile বলা যায়। তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে আমার কখনো কথা হয়নি। অথচ যায়যায়দিনের বাঁ ও ডান দিকের পাতায় আমার কলাম ‘চতুর্থ মাত্রা’ ও তসলিমার ‘নষ্ট কলাম’ ছাপা হয়েছে দীর্ঘদিন! তাকে নিয়েও অনেক কথা হলো।
মিনার খুব একটা রেসপন্ড করছিলেন না, তবে এ সময় প্রবাদটা মনে পড়ছিল: চোখে-মুখে দই, তারপরও কয় কই কই! কথায় কিংবা প্রসাধনে মানুষ বোঝা যায় না। যেমন একবার, এক নারী অত্যাধুনিক পোশাক, প্রসাধন, রোদচশমাসহ আমার কাছে তার সমস্যার কথা বলতে এসেছিলেন। এক পর্যায়ে ঝরঝর করে কেঁদেছিলেন তিনি। তার বহিরাঙ্গের সঙ্গে অন্তর্লোকের কোনোই মিল ছিল না। মিনারও যথেষ্ট স্মার্ট হয়েই কথা বলছিলেন; কিন্তু আমি জানতাম, তার ফকফকে গেঞ্জির তলায় যে বুক, সেখানে জমাট বেঁধেছে অনেক কষ্ট।
আমি জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টে এসেছিলাম মিনারের ক্যাবেই। আরও অনেকেই এসেছিলেন সি-অফ করতে। ইমিগ্রেসনে যাওয়ার আগে মিনারকে বলেছিলাম, পুনর্বার দেখা হওয়ার জন্য শুধু বেঁচে থাকতে হয়। আমাদের বাঁচতে হবে, যে কোনো প্রতিকূলতায়।
মিনার এসেছিলেন ঢাকায়, আর কী আশ্চর্য, পুনর্বার দেখা হয়নি। তারপর একদিন জানলাম, তিনি নেই! এই রাজধানীতে পাখিরও ভালো বাড়ি হয়, মিনারের ভালো চাকরি হয়নি। কী সেই রহস্য? তার তো দ্রব্যগুণ ও মোড়ক, দুটোই ভালো ছিল। তবে কি মালিক সম্প্রদায়ের এ এক অব্যাখ্যেয় উন্নাসিকতা? দিলাম না চাকরি, তাতে কী হয়েছে! মিনারকে যারা চিনতেন, তাদের কেউ তার চাকরির জন্য মালিকের অনুগ্রহ লাভের চেষ্টা করেছিলেন কিনা জানি না। এ দেশে মেধার চেয়ে বড় অনুগ্রহ। এটা পাওয়ার যোগ্যতা যাদের আছে, তারা আশীর্বাদপুষ্ট আর যারা পাননি, তারা অভিশপ্ত। ট্যালেন্ট হান্ট একটি ভুয়া শব্দদ্বৈত এ দেশে। পড়েছেন তো, অনুগ্রহেই কী করে চাকরি পেয়ে গিয়েছিলাম আমি!
পরিশিষ্ট: মিনার, কী লাভ হয়েছিল আত্মহননে? দেখতে পাওনি তোমার মৃত্যু কীভাবে নাড়া দিয়েছে আমাদের। কত ভালোবাসার পাত্র ছিলে, মরণই তা বলে দিয়েছে। সেটাও দেখতে পাওনি। প্রশ্ন আরও আছে। দু’চার দিনের শোক ছিল আমাদের, তারপর বিস্মৃতি। এটা কি একটা মূল্যবান জীবনের সমান হতে পারে? বোকারে বোকা!
পরিশিষ্ট-২ বিটিভির প্রতি সুবল বনিকের আক্রমণ পড়লেন। এবার হুমায়ুন আজাদেরটা পড়ুন। আশির দশকে আমরা যখন কালার্ড টেলিভিশন পেয়েছিলাম, তিনি লিখেছিলেন: বিটিভির আবর্জনাগুলো এখন রঙিন হলো!
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট।
খবরটি শেয়ার করুন