সোমবার, ২রা জুন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৯শে জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সিপিবি যে কারণে বিএনপি ও জামায়াতের 'ছায়াসঙ্গী' হতে চায়

বিশেষ প্রতিবেদক

🕒 প্রকাশ: ১২:৩৯ পূর্বাহ্ন, ১লা জুন ২০২৫

#

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। ফাইল ছবি (সংগৃহীত)

২০২৪ সালের ৫ই আগস্টে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে একটি অনুরোধ করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি ও বিশিষ্ট বামনেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। অনুরোধটি হলো- প্রথম আলো যেন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দলে জড়ানো দুটি গোষ্ঠীর কোনোটির পক্ষ না নেয়।

ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টার যেন একই ভূমিকা পালন করে, এর সম্পাদককে তা বলতেও মতিউর রহমানের কাছে অনুরোধ সেলিমের। আত্মীয়তার সম্পর্কে প্রথম আলোর সম্পাদক বেয়াই হন সেলিমের। তার বোন নাজনীন সুলতানা বিয়ে করেছেন প্রথম আলোর সম্পাদকের শ্যালক আব্দুল কাইয়ুম মুকুলকে। উদীচী ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধসহ এ দেশের প্রায় প্রতিটি যুগান্তকারী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী সিপিবির অন্যতম গণসংগঠন।

শুধু প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সম্পাদক নন, ঢাকার সংবাদমাধ্যমে কর্মরত পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ আরো কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন স্বাধীনতা-উত্তর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) প্রথম নির্বাচিত সহ-সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম। উদ্দেশ্য উদীচীর বিবদমান দুটি গোষ্ঠীর কোনোটির পক্ষ সংবাদমাধ্যমগুলো যেন না নেয়। সেলিমের ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র সুখবর ডটকমকে এসব তথ্য জানায়।

সূত্র বলছে, উদীচীতে দুটি পক্ষ দাঁড়িয়েছে সেলিমেরই ইশারায়। দু'পক্ষ দিয়ে তিনি রাজনীতির মোটাদাগের দুই ধারার দিকে যোগাযোগ রক্ষার 'কৌশল' করছেন। একটি পক্ষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাম রাজনীতির আদর্শের কথা বলছে। এ পক্ষকে দিয়ে তিনি আওয়ামী লীগ ও সমমনা বামদলগুলোর সঙ্গে প্রয়োজনে ভবিষ্যতে যোগাযোগ রক্ষার চেষ্টা করবেন।

আরেকটি পক্ষকে দিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সম্পর্ক রাখতে চাচ্ছেন সেলিম। তিনি, বা সিপিবি গত বছরের ৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে বিএনপি ও জামায়াতের 'ছায়াসঙ্গী' হতে চাচ্ছেন। সিপিবি মনে করছে, এ মূহুর্তে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের আনুষ্ঠানিক জোট না থাকলেও ভবিষ্যতে ক্ষমতা যাওয়ার লক্ষ্যে দল দু'টির মধ্যে আগের মতো জোট হতেও পারে।

তাছাড়া, বিএনপির সরকার গঠন করা, বা জামায়াতের সরকারে থাকার সম্ভাবনা আছে। কোনোটার জোটে যোগ না দিয়েও ক্ষমতার সুবিধা নিতে মুজাহিদুল সেলিম ও তার সাবেক দল সিপিবি 'ছায়াসঙ্গী' হিসেবে থাকতে চায় বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে।

উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর উদ্যোগে বিভিন্ন এলাকায় আয়োজিত জাতীয় সংগীত গাওয়ার অনুষ্ঠানে বিএনপির নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণ রাখছে সিপিবি। বিএনপির সঙ্গে দুরত্ব কিছুটা ঘুচিয়েছে সংগঠনটি। একইসঙ্গে সরকারের সঙ্গেও 'সুসম্পর্ক' রাখছেন সিপিবি ও মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।

তিনি সিপিবির দলীয় পদে না থাকলেও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও রাজনীতির গতিধারা নিয়ে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে তার উপস্থিতি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। বৈঠকে তিনি বলেন, 'পরিস্থিতির দিকে নজর রাখতে হবে। দেশের ভেতরে-বাইরে হওয়া নানা ষড়যন্ত্র থেকে দেশকে রক্ষা করতে না পারলে রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা হবে।'

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের বাইরের 'ষড়যন্ত্র' বলতে সেলিম ভারতকে ইঙ্গিত করেন। সরকারের নীতিনির্ধারকদের ভারতবিরোধী কণ্ঠে সুর মেলাতে তিনি ও বকেয়া বামনেতা মাহমুদুর রহমান মান্না, টিপু বিশ্বাস এমন প্রস্তাব করেন। ক্ষমতার পালাবদলের পর সেলিম 'পাকিস্তানপন্থী' হয়ে ওঠার চেষ্টায় আছেন বলেও কোনো কোনো বিশ্লেষকের অভিমত।

এখন 'কঠোর সমালোচক' হলেও শেখ হাসিনার 'কর্তৃত্ববাদী' শাসনামলে সিপিবি ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলনে দলটিকে সেভাবে দেখা যায়নি। একপর্যায়ে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম চালাকির আশ্রয় নেন। তিনি তত্ত্ব দেন ‘আপদ ও বিপদের'। সিপিবি থেকে ব্যাখ্যা করে বলা হয়, আওয়ামী লীগ হচ্ছে 'আপদ' আর বিএনপি 'বিপদ'। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড 'জায়েজ' করে সিপিবি।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে না থাকলেও দলটি গত ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে সিপিবি নানা সুবিধা নেয়। অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ২০০৯ সালে মহাজোটের সরকার গঠন হলে তার বোনকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে বসাতে ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তদ্বির করেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।

তার বোন নাজনীন সুলতানাকে প্রথমবারের মতো নারী ডেপুটি গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয় শেখ হাসিনার সরকার। নাজনীন সুলতানার চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর শেখ হাসিনার নির্দেশে বাড়ানোও হয়। তবে আলোচিত রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে তাকে ডেপুটি গভর্নরের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

ড. ইউনূসের সরকারের শুরু থেকে সেলিম ও সিপিবির ভূমিকা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনীর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বর্তমান রাজনীতিতে উগ্রপন্থার উত্থান নিয়ে সরব নন। পর্যবেক্ষকদের মতে, অতীতে সব সরকারের আমলেই সিপিবির ভূমিকা কম-বেশি প্রশ্নবিদ্ধ ছিল।

পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিভিন্ন ইস্যুতে সিপিবি আওয়ামী লীগের সঙ্গেই জোট করেছে কিংবা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আবার আওয়ামী লীগ যখনই রাজনৈতিকভাবে বিপদগ্রস্ত হয়েছে, বা বেকায়দায় পড়েছে, সিপিবির কণ্ঠে তখন উল্টো সুর শোনা গেছে। এসব বিষয়ে একাধিকভাবে চেষ্টা করেও সুখবর সেলিমের বক্তব্য জানতে পারেনি।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশাল গঠনে সিপিবির ভূমিকার কথা রাজনৈতিক মহলে এখনো আলোচিত। দলটির সভাপতি মণি সিংহ এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। পরে সিপিবি এ কথা 'অস্বীকার' করে। মণি সিংহ ও মোহাম্মদ ফরহাদের নেতৃত্বে সিপিবি বাকশালে বিলুপ্ত হয়।

যা বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে ছিল নজিরবিহীন ঘটনা। কারণ, এর আগে কোনো কমিউনিস্ট দল নিজের অস্তিত্ব বিলোপ করে অন্য দলে বিলীন হয়নি। সিপিবি জিয়াউর রহমানের খাল কাটা কর্মসূচি ও ‘হ্যাঁ-না’ গণভোটেও অংশ নেয় এবং তার সরকারকে সমর্থন দেয়।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় সিপিবি প্রথমে সক্রিয় ভূমিকায় ছিল। আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন দলটি আন্দোলন স্থগিত করে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় এবং নৌকা মার্কা প্রতীক নিয়ে মোহাম্মদ ফরহাদসহ সিপিবির পাঁচজন সংসদ সদস্য মনোনীত হন।

রাজনৈতিক অঙ্গনে সিপিবিকে তখন ব্যঙ্গ করে বলা হতো ‘নৌকা মার্কার কমিউনিস্ট পাটি।’ এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনেও দলটি আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কায় অংশ নেয়।

প্রসঙ্গত, দেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ও সর্ববৃহৎ সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দিনদিন প্রকট হচ্ছে। অগ্নিযুগের বিপ্লবী ও সাহিত্যিক-সংগঠক সত্যেন সেনের গড়া এবং সাংবাদিক-সাহিত্যিক রণেশ দাশগুপ্ত ও শহীদুল্লা কায়সারের স্মৃতিবাহী এ সংগঠনের কোন্দল এখন প্রকাশ্যে।

সংগঠনটির একপক্ষ মনে করে, অন্যপক্ষ ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সমর্থক এবং গত জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। ওই পক্ষের পাল্টা অভিযোগ, তাদের বিরোধীরা বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ট এবং বিদেশি সাহায্যপুষ্ট হয়ে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নেমেছিল। মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রশ্নে একসময়ের আপসহীন সংগঠনটির দু’পক্ষের বিরোধের শিকড় যে বেশ গভীরে প্রোথিত, তা সহজেই বোঝা যায়।

এইচ.এস/


মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন