প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম। ছবি: সংগৃহীত
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সরকার ডেইলি স্টারের সঙ্গে 'বৈরী আচরণ' করে বলে মনে করেন পত্রিকাটির সম্পাদক এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক মাহফুজ আনাম। ড. ইউনূসকে ঘিরে কোন ঘটনা থেকে, বা কখন-কীভাবে সাবেক আওয়ামী লীগের সরকারের পত্রিকাটির প্রতি 'শত্রুতা চরম পর্যায়ে পৌঁছায়', তাদের মন্ত্রীদের ড. ইউনূস এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকায় 'অপমানিত' হওয়া, এসব বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন মাহফুজ আনাম। তিনি এমন সময় এ বিষয়ে কথা বললেন, যখন ড. ইউনূস সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।
মাহফুজ আনামের এ বক্তব্যের পেছনে সরকার থেকে পত্রিকাটির জন্য সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার কারো কোনো উদ্দেশ্য আছে কী না, এমন প্রশ্ন তুলেছে পাঠকসমাজ। অনেক নেটিজেন অবশ্য তার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলছেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না বলে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূসের সরকারের আমলে স্বাধীনতা পেয়ে তিনি বিষয়টি জানিয়েছেন। সত্য সবসময়ই সত্য। সেটা কখন প্রকাশ হলো, তা মূখ্য নয়। মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে আওয়ামী সরকারের 'রাষ্ট্রদ্রোহী' মামলাগুলোও পত্রিকাটিকে নির্যাতনের অন্যতম প্রমাণ।
মাহফুজ আনামের অভিযোগ, ড. ইউনূসকে কেন্দ্র করে প্রায় ৪০টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে আওয়ামী লীগের সরকার ডেইলি স্টারে বিজ্ঞাপন না দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এতে পত্রিকাটির রাজস্ব ৪০ শতাংশ কমে যায়। পাঠকনন্দিত এ ইংরেজি পত্রিকার ওপর আওয়ামী লীগের সরকারের দমন-পীড়ন গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত অব্যাহত থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "তখন ডিজিএফআইকে ব্যবহার করে স্বাধীন ও মুক্ত গণমাধ্যমকে ভয় দেখানো হয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন না দিতে বাধ্য করা হয় শেখ হাসিনার সরকারের নির্দেশে। এ অঘোষিত 'নিষেধাজ্ঞা' ২০১৬ সাল থেকে টানা আট বছর বহাল ছিল।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের এক অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুখবর ডটকমকে এ প্রসঙ্গে বলেন, 'পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের চুয়ান্ন বছরের ইতিহাসে যারা ক্ষমতায় থেকেছে, তাদের মধ্যে কোনো সরকারই সংবাদমাধ্যমের সমালোচনা মেনে নিতে পারেনি। সম্পাদকীয় নীতিমালাসহ বিভিন্ন কারণে কোনো গণমাধ্যম যখন একটা সরকারের সমালোচনা করে, তখন সরকার সেটাকে শত্রুজ্ঞান করে। সাধারণত সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের সমর্থন করলে সরকার একটা প্রচারমাধ্যমের বিরোধিতা করে। ড. ইউনূসের মতো অরাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কের কারণে ডেইলি স্টারের বিরোধিতা করে সাবেক সরকার, এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়।'
ওই অধ্যাপক আরো বলেন, 'অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে ডেইলি স্টারের সম্পর্ক রাখার অন্য কোনো উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগের সরকার খুঁজে পেয়েছিল কী না, এ প্রশ্নও আসে। তবে ড. ইউনূসকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ডেইলি স্টারের রোষানলে পড়ার প্রসঙ্গটি এ মুহূর্তে মাহফুজ আনাম পাঠকদের না জানালেই ভালো হতো। কারণ, এ ধরনের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে পত্রিকাটির কেউ সরকারের কাছ থেকে অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিতে চাচ্ছেন কী না, কোনো কোনো পাঠকের মনে এ প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। এতে পাঠকসমাজে ডেইলি স্টারের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ও সততা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।'
মাহফুজ আনাম বলেন, '২০১৬ সালে আমাদের (ডেইলি স্টার) ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রধান অতিথি হিসেবে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আমন্ত্রণ জানানো হলে দ্য ডেইলি স্টারের প্রতি হাসিনা সরকারের বিরোধিতা চরমে পৌঁছায়। অনুষ্ঠানটিতে কয়েক হাজার আমন্ত্রিত অতিথি এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ২২ জন সম্পাদক উপস্থিত ছিলেন। ড. ইউনূস যখন মূল বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য মঞ্চে ওঠেন, তখন আওয়ামী লীগের কয়েকজন মন্ত্রী সেই অনুষ্ঠান থেকে বের হয়ে যান এবং উচ্চস্বরে অভিযোগ করতে থাকেন, মাহফুজ আনাম তাদের অপমান করেছেন।'
তিনি বলেন, "অভিযোগ তোলা হয়, ড. ইউনূস যেন হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাকে একটি বিশাল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে ডেইলি স্টার। (ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর লাগাতার বিরূপ মন্তব্য, ব্যক্তিগত আক্রমণ ও মিথ্যা মামলা থেকে এটা স্পষ্ট যে, ডেইলি স্টার ও এর সম্পাদককে তিনি কীভাবে দেখতেন)। এররপর থেকেই আমরা হাসিনার ঘোষিত 'শত্রু'তে পরিণত হই এবং তিনি আমাদের সঙ্গে তেমন আচরণই করেছেন। এর জেরে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে আমার একটি মন্তব্যকে অজুহাত বানিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমার বিরুদ্ধে মামলার ঢল নামে।"
তিনি বলেন, "আমাকে মোট ৮৪টি মামলায় অভিযুক্ত করা হয়, যার মধ্যে ১৬টি ছিল রাষ্ট্রদ্রোহের। তখনের প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার সংসদে দাঁড়িয়ে ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোকে 'রাষ্ট্রবিরোধী', 'আওয়ামী লীগবিরোধী' ও 'জনবিরোধী' বলে আখ্যায়িত করেন। অনেক আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য সংসদে দাঁড়িয়ে ডেইলি স্টারকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন এবং আমাদের বিরুদ্ধে 'ষড়যন্ত্র' করার অভিযোগ তুলেছেন। এমনকি অন্যান্য দলের কিছু সংসদ সদস্যও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন এবং ডেইলি স্টার বন্ধ করে দেওয়ার ও আমাকে কারাগারে পাঠানোর দাবি তুলেছেন।"
'অ্যা নিউ রিয়েলিটি ফর দ্য মিডিয়া, উয়ি মাস্ট লার্ন ফ্রম দ্য পাস্ট' শিরোনামের এক কলামে মাহফুজ আনাম এসব কথা বলেন। কলামটি সম্প্রতি ডেইলি স্টারের ছাপা সংস্করণে প্রকাশিত হয়। লেখাটিকে ঘিরে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেটিজেনদের মধ্যে নানামুখি আলোচনা ও বিশ্লেষণ চলছে। তারা এ-ও বলছেন, ডেইলি স্টার কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের সরকারের মুখপত্র হয়ে ওঠেনি। পত্রিকাটি দেশের কোনো রাজনৈতিক দলের সরাসরি মুখপত্র নয়। দেশীয় বাস্তবতায় তুলনামূলক স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য পত্রিকাটি অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সরকারের আমলে নানাভাবে নির্যাতিত-বঞ্চিত হয়।
মাহফুজ আনাম লেখেন, 'সংসদে ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) একবার ২১ মিনিট ধরে ডেইলি স্টার সম্পাদককে অপমান করেছেন, তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং নানা মিথ্যা অভিযোগ তুলেছেন। এর কয়েক বছর পর পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সময় তিনি সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ তোলেন যে, ডেইলি স্টার সম্পাদক আমেরিকায় গিয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করে পদ্মা সেতুর জন্য ঋণ বাতিল করানোর লবিং করেছি এবং এটা নাকি ড. ইউনূসের 'ষড়যন্ত্রেরই' অংশ ছিল। এ অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা ও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।"
তিনি বলেন, 'গত প্রায় ১৫ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন বা কোনো অনুষ্ঠানে ডেইলি স্টারের কোনো প্রতিবেদককে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি; প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফর, এমনকি সরকারপ্রধান হিসেবেও তাকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। ধীরে ধীরে দুয়েকজন বাদে তার মন্ত্রিসভার প্রায় সব সদস্য ডেইলি স্টারকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন। তারা আমাদের প্রতিবেদকদের সঙ্গে কথা বলতেন না, আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলতেন এবং সুযোগ পেলেই নানাভাবে অপদস্থ করার চেষ্টা করতেন।'
এইচ.এস/
খবরটি শেয়ার করুন