প্রতীকি ছবি - সংগৃহীত
শিশুশ্রমের প্রধান কারণ হলো দারিদ্র্য। একটি দরিদ্র পরিবারে বাড়তি আয়ের জন্য শিশুদেরকে কাজে পাঠানো হয়। সামান্য অর্থ প্রাপ্তির আশায় অভিভাবকরা শিশুদের স্কুলে পাঠানোর পরিবর্তে কাজে পাঠিয়ে দেন। এ ছাড়া দরিদ্র পরিবারের অশিক্ষা ও সচেতনতার অভাব বড় ভূমিকা পালন করে। অনেক অভিভাবকই জানেন না যে শিশুশ্রম সন্তানদের মানসিক গঠনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
বাংলাদেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজের পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণে শিশুদের কাজে লাগানোর সুযোগ থাকে। অনেক ছোট কারখানা কিংবা ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের বেশি কাজ করানো হয়। আর কন্যা শিশুদের বেশিরভাগকেই গৃহস্থালির কাজে নিযুক্ত করা হয়। বাংলাদেশে শহরাঞ্চল থেকে গ্রামাঞ্চলে শিশুশ্রমের হার বেশি। গ্রামাঞ্চলে শিশুশ্রমের হার ১৪ শতাংশ, যেখানে শহরাঞ্চলে ৫ শতাংশ।
দেশের মোট শিশুর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩৫ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে। তাদের মধ্যে ১০ লাখেরও বেশি শিশু শ্রমিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। আবার অধিকাংশ শিশু শ্রমিক পারিশ্রমিক পায় না। তাদের শুধু কাজ শিখানোর অজুহাতে পেটেভাতে কাজ করিয়ে নেন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা। আর যাদেরকে পারিশ্রমিক দেয়া হয়, তাদেরকেও প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও আইএলওর জরিপ মতে, কর্মক্ষেত্রে ৪৫ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ রয়েছে, তার মধ্যে শিশুরা ৪১টি কাজে অংশগ্রহণ করে থাকে। যারা গৃহপরিচারিকার কাজ করে তাদের বয়স ১৬ বছরের নিচে। ইউনিসেফের তথ্য মতে, গৃহ কাজের ৮৬ শতাংশই মেয়ে। ৩০ শতাংশের বয়স ছয় থেকে ১১ বছর, আর বাকিদের বয়স ১২ থেকে ১৬ পর্যন্ত। এরা প্রতিদিন ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করে থাকলেও নির্ধারিত শ্রমের পারিশ্রমিক পায় না।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্ব জুড়ে ৮৪ মিলিয়ন শিশুশ্রমের সঙ্গে যুক্ত। শিশুশ্রমের দিক দিয়ে আফ্রিকা ও এশিয়া বিশ্বের শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে। স্বল্প-আয়ের দেশগুলোতে শিশু শ্রমিকদের পরিমাণ বেশি হলেও, মধ্যম আয়ের দেশগুলোতেও এ সংখ্যা নেহাত কম নয়।
শিশুশ্রম ও শিশু নির্যাতনের মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। শিশুশ্রমে নিযুক্তরা প্রতিনিয়তই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। প্রায়শই গণমাধ্যমে ভয়াবহ নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হয়। যদিও যত সংখ্যক নির্যাতন হয়, তার এক শতাংশও প্রকাশ পায় না। এসব পরিস্থিতি শিশুদের মানসিকতায় ভীষণ প্রভাব পড়ে। যার কারণে অনেক ক্ষেত্রে শিশুরা বিপথে চলে যায়। নানা ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে শিশুশ্রম বন্ধে বেশ কয়েকটি আইন রয়েছে। যেমন বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী, ১৪ বছরের নিচে শিশুদের কাজ করা নিষিদ্ধ। তবে এসব আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কারণ অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের অসচ্ছলতার কারণে শিশুদের কাজে পাঠানো হয়। কিন্তু শিশুশ্রম আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হলে, রাষ্ট্রকে শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, তাদের বিকশিত হওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। জাতীয় শিশুনীতি ২০১১-এর ৮ ধারার ৮ দশমিক ৯ এ বলা হয়, যেসব প্রতিষ্ঠানে শিশুরা কাজে নিয়োজিত আছে, সেখানে শিশুরা যেন কোনোরূপ মানসিক, শারীরিক, যৌন নির্যাতনের শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে এবং তার কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে হবে।
শিশুশ্রম হলো একটি সামাজিক অপরাধ। যেখানে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক কাজে নিযুক্ত করা হয়, যা তাদের ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে দেয়। তারপরও শিশুশ্রম দিনদিন বেড়েই চলছে। গৃহস্থালির কাজ থেকে শুরু করে নির্মাণশিল্প, ইটভাটা, কৃষি কিংবা কারখানায় শিশুশ্রমিকের উপস্থিতি ক্রমে বাড়ছে। অভিভাবকদের দারিদ্র্য, শিক্ষার সুযোগের অভাব এবং অস্থির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শিশুদের শ্রমে ঠেলে দিচ্ছে। যা দেশের ভবিষ্যৎ প্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে অন্তরায়। একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ অকালেই ঝরে পড়ুক সেটা কারোই কাম্য নয়। এজন্য রাষ্ট্র ও সমাজকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। তাহলেই কেবল শিশুশ্রম কমে আসবে।
আই.কে.জে/