গত ২রা জুন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন। দীর্ঘ ১৭ বছর পর আবার জাতীয় সংসদের বাইরে বাজেট প্রস্তাব করা হলো। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বেতার-টেলিভিশনের মাধ্যমে বাজেট ঘোষণা করেছিলেন।
এ নিয়ে এখন পর্যন্ত ১২ বার জাতীয় সংসদের বাইরে বাজেট পেশ করা হলো। সাধারণত সপ্তাহের শেষদিনে বাজেট পেশ করা হয়; কিন্তু এবারের বাজেট সে প্রচলিত প্রথা মেনে হয়নি।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। নতুন বাজেট নিয়ে সাধারণ মানুষের তেমন আগ্রহ এবার দেখা যায়নি। মানুষ ধরে নিয়েছেন, নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এ বাজেট কাটছাঁট হবে।
অর্থ উপদেষ্টাও সম্ভবত ধরে নিয়েছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তার তেমন কিছু করার নেই, বেসরকারি বিনিয়োগের বাধা দূর করার মতো শক্তি আয়ত্তে নেই, কর্মসংস্থানের সংকট কাটবে না এবং দূর হবে না রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা।
সেজন্য বাজেটের আকার কম, প্রতিশ্রুতি স্বল্প আর আকাঙ্ক্ষাও সীমিত রেখেছেন উপদেষ্টা। তিনি যে বাজেট দিয়েছেন, তা দিয়ে হয়তো আপাতত টিকে থাকা যাবে, সামনে খুব বেশি আগানো যাবে না।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় এবার বরাদ্দ কমানো হয়েছে। যা মোটেও কাম্য নয়। বাজেটে নতুনত্ব হচ্ছে, নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে ১০০ কোটি টাকার বিশেষ একটি তহবিল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিনিয়োগ না বাড়লে সামগ্রিক অর্থনীতিতে যে শ্লথগতি বাড়বে, তা ঠেকানোর মতো উদ্যোগ তাতে নেই।
ফলে ব্যাংক খাতের উচ্চমাত্রার খেলাপি ঋণ (২০ দশমিক ২০ শতাংশ), মূলধন ঘাটতি এবং সুশাসনের অভাবে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোর পথে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে। আবার সরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও সরকার অতি সতর্ক, সেখানে আছে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও সংকোচনমূলক রাজস্ব নীতি।
মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরাকে এবারের বাজেটের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে দেখিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। বলা হয়েছে, গত ডিসেম্বর মাসের ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ থেকে মূল্যস্ফীতি এপ্রিলে নেমে এসেছে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশে। রমজান মাসেও পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ছিল বলা হলেও সেটা আংশিক সত্য। আলু-পেয়াজের দাম কম হলেও চাল-তেলসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি।
এখনও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতি বাংলাদেশে। এখন মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে স্বস্তি চান, কর্মহীনরা কাজ চান, সাধারণ মানুষ নিরাপত্তা চান, ব্যবসায়ীরা অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি চান। মানুষের প্রত্যাশা ছিল, নতুন অর্থবছরে অন্তত এসব চাওয়া পূরণ হবে। কিন্তু অর্থ উপদেষ্টার বক্তব্যে এসবের দিকনির্দেশনা নেই।
রাজস্ব আদায় ও দেশীয় শিল্প সুরক্ষার লক্ষ্য নিয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে বেশকিছু ভোগ্যপণ্যের ওপর কর, শুল্ক ও ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, যার ফলে বাজারে এসব পণ্যের দাম বাড়বে—সাধারণ মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন খরচে প্রভাব পড়বে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আয়ের বৈষম্য হ্রাস, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ—এ বিষয়ে কোনও সুস্পষ্ট কৌশলগত রূপরেখা নেই। ফলে এ বাজেটে অস্বস্তি বাড়বে।
অর্থ উপদেষ্টা তার বাজেট বক্তৃতায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ও সর্বস্ব ত্যাগ স্বীকার করা মা-বোনদের কথা স্মরণ করেছেন, শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন চব্বিশের আন্দোলনের শহীদদের কথাও। একাত্তর ও চব্বিশ—দুই সংগ্রামেরই যে উদ্দেশ্য ছিল বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলা, বাজেট প্রস্তাবে তার প্রতিফলন তেমন নেই।
বাজেট প্রণয়নের চেয়ে বাস্তবায়ন অনেক কঠিন কাজ। আমরা আশা করতে চাই, রাজনৈতিক সরকারের আমলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে যে দুর্নীতি, অনিয়ম ও অপচয় হতো, অন্তর্বর্তী সরকার সেটা পুরোপুরি বন্ধ করতে না পারলেও অনেকখানি কমিয়ে আনতে পারবে। সে ক্ষেত্রে ‘অর্ধেক গ্লাস খালি, অর্ধেক গ্লাস পূর্ণ বাজেট’ থেকেও জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত হতে পারে।
এইচ.এস/
খবরটি শেয়ার করুন