ছবি - সংগৃহীত
রবিউল হক
পঞ্চগড়ের লোকশিল্পের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে বাঁশ, বেত, পাট, মাটি ও কাপড়ের তৈরি নানা উপকরণের মধ্যে। এ জেলায় কামার, কুমার, ছুতার, ঘরামি, তাঁতি, সোনারু, কাসারি প্রভৃতি পেশাজীবী তাদের সৃষ্টির পথ আকীর্ণ করে না রেখে বরং বংশ ও ঐতিহ্য পরম্পরায় মৃৎশিল্প, দারুশিল্প, পাটজাত শিল্প, বাঁশ ও বেতের শিল্প, সুচিশিল্প, শোলা শিল্প ইত্যাদি লোকশিল্পে অবদান রেখে চলেছেন।
পঞ্চগড়ের লোকশিল্পের মধ্যে মৃৎশিল্পের একটি বৃহৎ ক্ষেত্র লক্ষ করা যায়। মৃৎশিল্পের মধ্যে বিভিন্ন ঠাকুরের পট ও দেব-দেবীর মূর্তি, খেলনা পুতুল ও ঘোড়া-হাতি, বিয়ে অনুষ্ঠানের পেচি ও চুনাতি, কুপি বা প্রদীপ, ঢেঁকি, টকা, তাড়ি (পাত্র), ঢাকন বা ঢাকনা, চারখুটিয়া, হুক্কার ছিলিম, পূজা প্রদীপ, মঞ্চ প্রদীপ, গাঁজার প্রদীপ, ঘট, সরা, আদি সরা, সুরাহি, মনসার পট, মাটির লক্ষ্মী, মহামারি ঠাকুরের পট, পোড়ামাটির হাতি ও ঘোড়া, কলস ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের মৃৎশিল্পের ইতিহাস সুপ্রাচীনকালের। মধ্যপ্রাচ্যেই সর্বপ্রথম মৃৎশিল্পের অস্তিত্ব মেলে এমন ধারণা গবেষকদের। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার উত্তর ভূভাগে মাটি খুঁড়ে প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার লিওনার্দো উলে তিন হাজার বছর আগের তৈরি মৃৎপাত্র উদ্ধার করেন বলে জানা যায়। এছাড়াও মানুষ, গরু, মহিষ, ভেড়া, বানর, শূকর, মুরগি, পাখি, মার্বেল, খেলনার পুতুলসহ পোড়ামাটির অসংখ্য প্রতিমা মৃৎশিল্পের নমুনা হিসেবে উদ্ধার করা হয়। দেশের অন্যান্য স্থানের মতো পঞ্চগড় জেলার দারুশিল্প এ অঞ্চলের লোকসংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। কাঠের তৈরি আসবাবপত্রে হাতের সুনিপুণ এসব নকশা স্থান পায় কাঠে খড়ম, পিঁড়ি, গাছা, ছাম, গাহীন, ঢেকি, পানের বাটা, হুকা, লাঙ্গল, চাকা, অলংকার রাখার বাক্স প্রভৃতি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রীর মধ্যে। চাহিদার প্রয়োজনে গড়ে উঠেছে পঞ্চগড় জেলার পাটকেন্দ্রিক বিভিন্ন শিল্প। এ জেলার পাটকেন্দ্রিক পণ্য ও জিনিসপত্রের মধ্যে বটিয়া পাটের আঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়।
পঞ্চগড় জেলার বিভিন্ন গ্রামের নারীরা অবসর সময়ে সুচিশিল্পের বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সুচিশিল্পের মধ্যে রয়েছে কাঁথা, কাপড়ের পাখা, পরিধেয় কাপড়, নকশি কাপড়, নকশী কলস, নকশী জামা, পাথরের থালাবাটি, দস্তরখানা, নকশী টেবিলের কাপড়, রুমাল, নকশী টুপি, পোড়ামাটির কাজ, কাঠের নকশাখচিত আসবাব, বাঁশের চালনি, ধামা, বেতের দরজা, বাঁশের চেকর, বেড়া, সিলিং, টাটর, ধারা, খাড়া, ঢাকি, কুলা, চালুনি, খাচি, বেধা, বইঙ্ঘা, ভার, পিঁড়ি, চোঙ্গা, চামচ, লাকড়ি, মাচা, ডোলি, ট্যারা ইত্যাদি তৈরি করা হয়। এছাড়া বাঁশ ও বেতের তৈরি পাখার ব্যবহার রয়েছে। এ সকল শিল্পকর্ম ছাড়াও লোকশিল্পের অন্যান্য নিদর্শনও পঞ্চগড় জেলায় বেশ লক্ষ করা যায়। এদেশের লোকসংস্কৃতির ভাণ্ডারে পঞ্চগড় জেলার লোকশিল্পের অবদান অনস্বীকার্য।
তথ্যসূত্র
১. নাজমুল হক, উত্তরবঙ্গের লোকসাহিত্যের নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক সমীক্ষা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০৭
২. শামসুজ্জামান খান, (সম্পা.), বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা: পঞ্চগড়, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৩
৩. মুহম্মদ আবদুল জলিল, বাঙলাদেশের ফোকলোর চর্চার ইতিবৃত্ত, অনার্য, ঢাকা, ২০১১
রবিউল হক, লোক গবেষক ও শিল্পী
আই.কে.জে/